উপজেলা পরিষদকে সচল করতে হবে

samakal_logo

সুশাসন
বদিউল আলম মজুমদার
গত ২২ জানুয়ারির এবং পরবর্তী সময়ে কতগুলো স্থগিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় দু’দশক পর সারাদেশে উপজেলা পরিষদ গঠিত হয়েছে, যদিও পরিষদে নারী সদস্যদের পদ এখনও পূরণ হয়নি। এরপর নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ১৯৯৮ সালে প্রণীত উপজেলা আইনের সংশোধন ও পুনঃপ্রচলন করে একটি আইনি কাঠামোও তৈরি হয়েছে। কিন্তু আজও উপজেলা পরিষদ সচল হয়নি; বরং উপজেলা পর্যায়ে বর্তমানে একটি চরম নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে। জাতীয় স্বার্থে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দিনবদলের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এর বিহিত হওয়া আজ অতীব জরুরি।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা আওয়ামী লীগের দিনবদলের সনদ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম অগ্রাধিকার। এতে সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করা হয়েছে : ‘ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদকে শক্তিশালী করা হবে। জেলা পরিষদকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-শৃঙ্খলা ও সব ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। প্রতিটি ইউনিয়ন সদরকে স্থানীয় উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু, পরিকল্পিত পল্লী জনপদ এবং উপজেলা সদর ও বর্ধিষ্ণু শিল্প কেন্দ্রগুলোকে শহর-উপশহর হিসেবে গড়ে তোলা হবে।’
একইভাবে দিনবদলের সনদে অন্তর্ভুক্ত ২০২১ সালের জন্য প্রণীত রূপকল্পে ‘রাজনৈতিক কাঠামো, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও গণঅংশায়ন’-এর প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে : ‘স্থানীয় সরকারকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন সাধন করা হবে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়ামক ভূমিকা পালন করবে স্থানীয় সরকার। এ উদ্দেশ্যে জেলা ও উপজেলার স্থানীয় সরকারকে স্বনির্ভর ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে।’
আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেও তার দারিদ্র্য দূরীকরণ : কিছু চিন্তাভাবনা (আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৫) শীর্ষক গ্রন্থে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে স্বশাসিত ও শক্তিশালী করার পক্ষে দৃঢ় মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পভিত্তিক বা সমাজকল্যাণমূলক, ছিটেফোঁটা অনুদান বা ঋণ বিতরণ বা খয়রাতি সাহায্য হিসেবে কর্মসূচি গ্রহণ করলে চলবে না… দারিদ্র্য যেহেতু বহুমাত্রিক একটি সমস্যা, সেহেতু শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় ও কর্মসংস্থান বাড়ালেই চলবে না, তার খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষমতাও বৃদ্ধি করতে হবে। বাড়াতে হবে তার অধিকার-সচেতনতা, তার সংগঠন করার ক্ষমতা, স্থানীয় পর্যায়ে স্বশাসিত সরকারের (খড়পধষ ঝবষভ-মড়াবৎহসবহঃ) কার্যক্রমে তার অংশগ্রহণের মাত্রা।’
প্রধানমন্ত্রী আরও লিখেছেন : ‘দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য যে ধরনের উন্নয়ন-চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা দরকার তার সামর্থ্য বা সদিচ্ছা কোনোটিই এই আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের নেই… আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থা নয়, একমাত্র বিকেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র-ব্যবস্থায়ই দারিদ্র্য দূরীকরণের কর্মসূচি দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়ন ও তাতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে। এবং এটি করার জন্য দক্ষ প্রতিনিধিত্বশীল একটি স্থানীয় সরকার কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।’
স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি আরও লেখেন : “ইতিপূর্বে ‘স্থানীয় সরকার’ গড়ার প্রচেষ্টা বিভিন্ন সময়ে দেখা গেলেও কার্যত তা কেন্দ্রীয় সরকারের সম্প্রসারিত শাখায় পর্যবসিত হয়েছিল এবং অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় সরকারকে সরকারি দলের রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া যেমন একটি দিক, স্থানীয় সংগঠনের প্রতিনিধিদের অধিকার সম্প্রসারণও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমি এখানে যে স্থানীয় সরকারের কথা বলছি, তা হবে স্থানীয় পর্যায়ে সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি। এর জন্য চাই স্থানীয় সরকার কাঠামোর প্রতিনিধিত্বশীলতা ও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্তি, কেন্দ্রীয় সরকার ও আমলাতন্ত্রের প্রভাব বলয়ের বাইরে এর স্ব-অধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা এবং স্থানীয় পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে স্বাবলম্বিতা অর্জনের নিশ্চয়তা।’ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী তার লেখায় দান-অনুদানের সংস্কৃতির বাইরে এসে জনগণকে সম্পৃক্ত করে স্বশাসিত, শক্তিশালী ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে ‘আন্দোলনে’ পরিণত করার ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে আমাদের ধারণা। আর এর মাধ্যমেই ‘কৃষি ও পল্লী জীবনে গতিশীলতা’ অর্জন করা সম্ভব। এজন্য অবশ্য প্রয়োজন হবে একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সব সম্পদ ও জনবলকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো। উল্লেখ্য, কৃষি ও পল্লী জীবনে গতিশীলতা অর্জনও দিনবদলের সনদের অন্যতম অগ্রাধিকার।
প্রধানমন্ত্রীর নিজের ব্যক্তিগত প্রত্যয় এবং নির্বাচনী ইশতেহারের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও নির্বাচনের ৬ মাস পরও উপজেলা পরিষদ সচল হয়ে ওঠেনি। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির কোনো কর্মসূচিই এ পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। ফলে নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের অনেকেই কোনো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেননি। তাদের অনেকে হতাশার সুরে বলেন, তাদের কোনো কাজ নেই।

সর্বোপরি, বর্তমানে তৃণমূল পর্যায়ে একটি চরম বিশৃঙ্খল ও দ্বন্দ্বাত্মক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্যের মধ্যে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যানদের মধ্যে দ্বন্দ্বও ব্যাপক। নির্বাচিত উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনেক ক্ষেত্রে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের নিজেদের মধ্যে। সংসদ সদস্যদের ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপের কারণে, যদিও এ ব্যাপারে তাদের কোনো আইনগত এখতিয়ার নেই, সেখানেও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। একইসঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপের কারণে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে কিছু উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে।
ক্ষমতার লড়াইয়ে কে কার চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান_ মূলত দ্বন্দ্ব এ কারণেই। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, যেখানে দ্বন্দ্ব ও হানাহানি সেখানে ইতিবাচক কিছু ঘটে না। ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক সহযোগিতা ও একে অপরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার মানসিকতা। এর জন্য আরও প্রয়োজন যথোপযুক্ত পরিবেশ। দুর্ভাগ্যবশত নতুন উপজেলা আইনের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের এখতিয়ারের বাইরে স্থানীয় সরকারের কক্ষপথে প্রবেশের অধিকার দিয়ে যা নষ্ট করা হয়েছে। তাই নিরাপত্তা বেষ্টনীর অধীনে কিছু দান-অনুদান প্রদান করা ছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে বর্তমানে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন গতিশীল করার কর্মকাণ্ডে অনেকটা স্থবিরতা বিরাজ করছে। এছাড়াও দ্বন্দ্বাত্মক পরিস্থিতির কারণে তৃণমূল পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা চরম চাপের মধ্যে রয়েছেন_ অনেক ক্ষেত্রে তারা বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন এবং অনেকের পক্ষে আত্মসম্মান বোধ বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করা দুরূহ হয়ে পড়ছে।
অশুভ প্রতিযোগিতা ও অনাকাঙ্ক্ষিত দলীয় প্রভাবের কারণে অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত বিধি-বিধানও মানা হচ্ছে না। বস্তুত কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মই নিয়ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেমন- অনেক সংসদ সদস্য ইউনিয়ন পরিষদকে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে বলে দিচ্ছেন নিরাপত্তা বেষ্টনীর অধীনে প্রাপ্ত বরাদ্দ কীভাবে বিতরণ হবে, কাদের মাধ্যমে বিতরণ হবে ইত্যাদি। কিছু উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে একটি অরাজক অবস্থা বিরাজ করছে। আর এর পরিণতি অশুভ হতে বাধ্য। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ আজ অতি জরুরি হয়ে পড়েছে।
বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য উপজেলা পরিষদকে অর্থবহ কাজের মধ্যে নিবিষ্ট করা আবশ্যক। আর এর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন উপজেলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে এমন চেতনা জাগ্রত করা যে, তারা নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু ক্ষমতাই নয়, দায়িত্বপ্রাপ্তও হয়েছেন। ভোটাররা তাদের দায়িত্ব দিয়েছেন উপজেলা পরিষদকে কার্যকর ও সচল করার। এ দায়িত্ব পালনের জন্যই তাদের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। আর শুধু নির্বাচিত চেয়ারম্যানরাই নন, ভাইস চেয়ারম্যানরাও এমনিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। শুধু সমস্যা তুলে ধরলেই কিংবা অজুহাত দিলেই এ গুরুদায়িত্ব পালিত হবে না, এর জন্য প্রয়োজন হবে সুস্পষ্ট ও গঠনমূলক পদক্ষেপ। এমন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির জন্য আজ জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজন নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন। আর এ প্রশিক্ষণ হতে হবে অবশ্যই ব্যতিক্রমধর্মী, যার মাধ্যমে তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রত্যয়-প্রতিশ্রুতির সৃষ্টি হবে।
প্রশিক্ষণে সাধারণত কিছু ‘শিক্ষক’ প্রশিক্ষণার্থীদের তাত্তি্বক ও জ্ঞানগর্ভ বিষয়ে তালিম দিয়ে থাকেন। প্রশিক্ষণার্থীদের অনেক দুরূহ বিষয় গেলানো হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রশিক্ষণার্থীদের কেউ কেউ সমৃদ্ধ হলেও অনেকের জন্য বদহজমের সৃষ্টি হয়। এমন ছকবাঁধা পদ্ধতি নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের প্রশিক্ষণের জন্য উপযোগী হবে বলে মনে হয় না। তাদের প্রশিক্ষণের মূল লক্ষ্য হতে হবে সুস্পষ্ট কার্যক্রম চিহ্নিত করা, কার্যক্রমগুলো আইনানুগভাবে বাস্তবায়নের জন্য পথরেখা খোঁজা এবং সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তা করার জন্য তাদের অঙ্গীকারবদ্ধ করা।
বহু বছর থেকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের প্রশিক্ষণ প্রদানের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা মনে করি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের প্রথম দফার প্রশিক্ষণ কয়েকটি সীমিত বিষয়ের ওপর নিবিষ্ট হওয়া আবশ্যক। প্রথম বিষয়টি হওয়া উচিত প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে একটি আত্মজিজ্ঞাসার সৃষ্টি করা_ তারা কারা? অংশগ্রহণমূলক আলোচনার মাধ্যমে তাদের মধ্যে এ উপলব্ধির সৃষ্টি করতে হবে যে, তারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাদের নেতা-কর্মকর্তা নন। নেতা সমস্যার সৃষ্টি করেন না, বরং সমস্যার সমাধান করেন, যা স্বাভাবিকভাবে ঘটার নয়, তা তারা ঘটান। নেতা ‘ক্যাটালিস্ট’ বা অনুঘটক। তাই আইন করে নেতৃত্ব সৃষ্টি করা যায় না। নেতা অন্যের নেতৃত্ব ক্ষমতায়িত করেন এবং যত বেশি ব্যক্তি নেতৃত্ব প্রদর্শন বা দায়িত্ব গ্রহণ করেন, নেতার সফলতা তত বেশি। আর জনগণের নেতা হিসেবে তারা জনগণ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন প্রবল প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও উপজেলা পরিষদকে সচল ও সফল করার জন্য।
তাদের মধ্যে আরও উপলব্ধির সৃষ্টি হতে হবে যে, ভোটাররা উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করেছেন এবং পরিষদকে সচল করা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের যৌথ দায়িত্ব। তাদের মধ্যে আরেকটি উপলব্ধি হওয়া জরুরি যে, জনকল্যাণমূলক সেবা বিতরণ এবং জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন (যা স্থানীয় সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব) সম্পর্কিত কাজের অন্ত নেই, তাই উপজেলা পর্যায়ে করার মতো বহু কাজ রয়েছে। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে উপলব্ধি হতে হবে যে, উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করা যাবে না, তাই তাদেরও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের টিমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে হবে।
প্রশিক্ষণের আরেকটি দিক হতে হবে, সংশ্লিষ্ট আইনি বিধি-বিধানের সঙ্গে তাদের পরিচিত করানো। একই সঙ্গে তাদের পরিচিত করানো পরিষদ পরিচালনার নূ্যনতম কিছু নিয়ম-নীতি (যেমন- সভা পরিচালনা, কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধকরণ, হিসাব-নিকাশ সংরক্ষণ ইত্যাদি) বিষয়ে। প্রশিক্ষণে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে আইনে নির্দিষ্ট (তফসিল ২-৩) কার্যক্রমগুলো সম্পর্কে তাদের মধ্যে সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি এবং এগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তাদের করণীয় চিহ্নিত করার ওপর। কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সম্পদের প্রবাহ ও সম্ভাব্য অন্যান্য উৎস সম্পর্কেও তাদের জানতে হবে। নারীর সম্পৃক্ততা ও পরিবেশ বিষয়ও প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত হওয়া আবশ্যক।
সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম ও সম্পদের প্রবাহ চিহ্নিত করে একটি পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধিও প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক। আরও আবশ্যক এ লক্ষ্যে কিছু সুস্পষ্ট পদক্ষেপ চিহ্নিত করা। পরিকল্পনাটি হতে হবে ভবিষ্যতের ‘ভিশন’ বা প্রত্যাশার ভিত্তিতে। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে মাঠ ভিজিটের মাধ্যমে পরিকল্পনা প্রণয়নের ব্যাপারে কিছু হাতে-কলমের অভিজ্ঞতা অর্জিত হতে পারে। তবে এজন্য প্রয়োজন হবে প্রশিক্ষণ পরবর্তীকালে বিশেষজ্ঞদের উপজেলায় গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে পরিকল্পনা দলিল দাঁড় করানো।
নিঃসন্দেহে উপজেলা পরিষদকে সচল ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বহু কিছু করার রয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে ভুললে চলবে না যে, সরকারের নীতি-নির্ধারণে পরিবর্তন এবং বিদ্যমান আইনি কাঠামোর আমূল পুনর্বিন্যাস ছাড়া তাদের পক্ষে পুরোপুরি সফল হওয়া সম্ভব নয়। আর আইনের পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কতগুলো মৌলিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় রাখা দরকার। যেমন_ প্রথমত, স্থানীয় সরকারও একটি সরকার, তাই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা হতে হবে স্বায়ত্তশাসিত। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো আইনানুযায়ী নির্বাচিত স্থানীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে, জাতীয় সংসদ সদস্যদের দ্বারা নয়। তৃতীয়ত, ‘স্থানীয় শাসনে’র দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হলে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়দায়িত্ব থাকতে হবে (অনুচ্ছেদ ৫৯)। চতুর্থত, এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের জোগান থাকতে হবে। পঞ্চমত, এগুলোর মাধ্যমে প্রশাসনের সব পর্যায়ে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে হবে। ষষ্ঠত, এগুলোতে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর, বিশেষত নারী, কৃষক ও শ্রমিকের অন্তর্ভুক্তিকরণ নিশ্চিত করতে হবে (অনুচ্ছেদ ৯)। সপ্তমত, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার বিধান থাকতে হবে। অষ্টমত, স্থানীয় সরকারের প্রত্যেকটি স্তর হতে হবে স্বাধীন, অর্থাৎ পরস্পরের নিয়ন্ত্রণমুক্ত। উল্লেখ্য, এসব বৈশিষ্ট্যের অনেকই কুদরত-ই-এলাহী পনির মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে উলি্লখিত আছে। এজন্য আরও প্রয়োজন হবে উপজেলা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরিষদে জরুরিভিত্তিতে ন্যস্ত করা।
আমরা আশান্বিত হয়েছি, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর, সংসদের আগামী অধিবেশনে বিদ্যমান উপজেলা আইনটি সংশোধন করার ঘোষণা দিয়েছেন। আশা করি, তিনি তার কথা রাখবেন এবং উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর আলোকে বিদ্যমান আইনটির পুনর্বিন্যাস করবেন এবং নীতি-নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনবেন। জাতীয় স্বার্থে আজ তা করা জরুরি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক

তথ্য সূত্র: দৈনিক সমকাল, ১৩ আগষ্ট ২০০৯

Related Post

উপসর্গ নয়, রোগের চিকিৎসা জরুরিউপসর্গ নয়, রোগের চিকিৎসা জরুরি

বদিউল আলম মজুমদার ২৫ নভেম্বর দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে গত সপ্তাহ তিনেক চলমান সহিংসতায় শতাধিক ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে। অসংখ্য ব্যক্তি আহত হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কারসুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কার

বদিউল আলম মজুমদার নির্বাচনী অপরাধের প্রায় সবগুলোরই উৎস রাজনৈতিক দল, তাদের মনোনীত প্রার্থী ও দলের নেতাকর্মীরা। দল ও দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই মনোনয়ন বাণিজ্যে লিপ্ত হয়, টাকা দিয়ে ভোট কেনে, পেশিশক্তি