এমন বন্ধু থাকলে…

 

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ০৫-১২-২০১০

ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের সাম্প্রতিক বক্তব্য (যুগান্তর, ৩ নভেম্বর ২০১০) পড়ে আমরা আশ্চর্য হয়েছি। তিনি দাবি করেছেন, কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব সময় প্রস্তুত ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু সরকারের অনীহার কারণেই ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হলো না।

বিগত ২০০৪-০৮ সময়কালের বহু দাবি ও আন্দোলনের ফসল বর্তমান নির্বাচিত সরকার। এ আন্দোলনের পুরোভাগেই ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং তার প্রধান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যদিও চারদলীয় জোট সরকারের আমলের পাতানো নির্বাচন ঠেকানোর ব্যাপারে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের ভূমিকা কোনোভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগ দলীয় একটি নির্বাচিত সরকার প্রশাসনের সর্বস্তরে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা হয়ে দাঁড়াবে—তা অভাবনীয় ও অবিশ্বাস্য। এর কোনো যৌক্তিকতা আমরা খুঁজে পাই না। বরং সরকারের কার্যক্রম দেখে আমাদের মনে আশঙ্কা জাগে: গণতন্ত্র কি আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য শুধুই স্লোগান? আর তা কি নিতান্তই জনগণকে ‘ঘুম পাড়ানোর’ গান?

বহু তূর্যনিনাদ বাজিয়ে গত ২৯ ডিসেম্বর, ২০০৮ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পুনঃপ্রবর্তন। কারণ, গণতন্ত্র আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার (অনুচ্ছেদ-১১) এবং এর জন্য আমরা অনেক আত্মত্যাগ করেছি। আর নির্বাচন গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত, যদিও নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়। সত্যিকারের গণতন্ত্র তথা গণতান্ত্রিক শাসনের কার্যকারিতা নির্ভর করে নির্বাচনের পর সরকারের আচরণ ও কার্যক্রমের ওপর।

নির্বাচন কমিশনারের মন্তব্য পড়তে গিয়ে একটি অতি পুরোনো ও জনপ্রিয় গানের কলির কথা মনে পড়ে যায়, ‘উইথ ফ্রেন্ডস লাইক দিজ, হু নিডস এনিমিস!’ অর্থাৎ, এমন বন্ধু থাকলে শত্রুর কী প্রয়োজন! (যতটুকু মনে পড়ে, বেশ কয়েক বছর আগে এ নিয়ে একটি সিনেমাও হয়েছিল।) আমাদের সরকার ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের নামে যা কিছু করছে এবং অতীতে করেছে, তা দেখে মনে হয় যেন গণতন্ত্রকে অকার্যকর এবং ধিক্কৃত করার জন্য তারাই যথেষ্ট—এর জন্য অন্য কোনো শক্তি ও শত্রুর প্রয়োজন নেই। তারা যেন গণতন্ত্র ‘সবচেয়ে খারাপ ধরনের পদ্ধতি…’—চার্চিলের এ কথাকে সত্য প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর। কারণ, তারা যে গণতন্ত্রের নামে খেলায়, বস্তুত প্রহসনে লিপ্ত, তার পরিণতি অশুভ হতে বাধ্য।

রাজনীতিবিদেরা আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে একমাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সরকার গঠিত হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং এরপর রূপকথার কেচ্ছার মতো যেন ‘এভরিওয়ান উইল লিভ হ্যাপিলি দেয়ারআফটার’—সবাই পরবর্তী সময়ে মহা সুখে বসবাস করবে। গণতন্ত্র কায়েমের জন্য আর কিছুই করার দরকার নেই। প্রান্তে নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজন নেই।

অবশ্যই গণতন্ত্র কায়েম করার জন্য সংসদ নির্বাচন অতি অপরিহার্য। কিন্তু জাতীয় সংসদে ৩০০ জন নির্বাচিত এবং সংরক্ষিত আসনে ৪৫ জন নারী মনোনীত হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না। কারণ, গণতন্ত্র হলো নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের সম্মতির শাসন। অর্থাৎ স্বশাসন। আর যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকে, সেখানে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই স্বশাসন কায়েম হয়। তাই শুধু কেন্দ্রেই নয়, প্রশাসনের সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্র বা স্বশাসন কায়েমের পথ সুগম হয় না। বরং এতে আংশিক এবং অনেকটা বিকৃত ধরনের গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কারণ, গণতন্ত্র আংশিক হয় না। আর বিকৃত গণতন্ত্র অকার্যকর ও অস্থিতিশীল না হয়ে পারে না।

আমাদের সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সত্যিকার ও পরিপূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট পথরেখা দেওয়া আছে। সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে প্রশাসনের সব অংশ বা স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানের ওপর ‘স্থানীয় শাসনে’র ভার প্রদানের দ্বিধাহীন নির্দেশনা রয়েছে। অর্থাৎ, সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচিত জেলা পরিষদের ওপর জেলার, নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের ওপর উপজেলার, নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের ওপর ইউনিয়নের, নির্বাচিত সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিদের ওপর নগরের এবং নির্বাচিত পৌর পরিষদের ওপর পৌর এলাকার শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার কথা। কারণ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ‘তৃণমূলের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিপূর্ণতা লাভ করে না, তা কার্যকর হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।

বলা বাহুল্য, সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই গণতন্ত্র গভীরতা অর্জন করে, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় এবং সরকার পরিচালনায় জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। ফলে রাষ্ট্রে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের পরিবর্তে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়, যা নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের উন্নততর সংস্করণ। বস্তুত এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সব ক্ষমতার ‘মালিক’ হিসেবে স্বীকৃত জনগণকে, যারা বাস্তবে ক্ষমতাহীন, ক্ষমতায়িত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভ করে। একই সঙ্গে জনগণের কাছে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সরাসরি দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঢাকা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠান না করে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করছে (যদিও সম্প্রতি ২৬৯টি পৌরসভার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে)। জেলা পরিষদের নির্বাচন না করে তারা সংবিধানকে আরও নগ্নভাবে পদদলিত করছে। কারণ, সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদই জেলাকে ‘প্রশাসনিক একাংশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যদিও শুধু আইনের মাধ্যমে অন্যান্য প্রশাসনিক স্তরকে প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই জেলা পরিষদের নির্বাচন এড়াতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্বাধীন বাংলাদেশে জেলা পরিষদের নির্বাচন একবারও অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে অনেকেই মনে করেন, জেলা পরিষদের নির্বাচন নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হলে এবং ১৯৯১ সালে উপজেলা ব্যবস্থা বাতিল না করলে বাংলাদেশে ‘এমপিরাজ’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতো না এবং আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ত না। ফলে আমাদের ইতিহাসও অন্য রকম হতো।

শুধু সংবিধান লঙ্ঘনই নয়, প্রশাসনিক একাংশ বা ইউনিট হিসেবে ঘোষিত স্তরগুলোতে যথাসময়ে নির্বাচন না করে আমাদের একের পর এক সরকার দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতিও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে। অনেকেরই স্মরণ আছে, উপজেলা পরিষদ বাতিলের পর দায়ের করা ‘কুদরত-ই-ইলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ’ [৪৪ ডিএলআর (এডি)(১৯৯২)] মামলার রায়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ১৯৯২ সালে স্থানীয় সরকারের সর্বস্তরে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সর্বসম্মত রায় দেন। এ রায়ের ১৮ বছর পরও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে আমাদের সরকারগুলো বিভিন্ন ধরনের টালবাহানায় লিপ্ত, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

উপরন্তু মেয়াদোত্তীর্ণ ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন না করে বর্তমান সরকার নিজেদের পাস করা আইনও অমান্য করছে। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এর ৩৪ ধারা অনুযায়ী, নতুন আইনের অধীনে গঠিত সিটি করপোরেশনের নির্বাচন, আইনটি বলবৎ হওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই সময়সীমা গত এপ্রিল মাসে পার হয়ে গেছে।

প্রসঙ্গত, সময়মতো নির্বাচন না করার মাধ্যমে আইন অমান্য করেই যেন বর্তমান সরকার সন্তুষ্ট নয়, তারা সিটি করপোরেশন আইন লঙ্ঘন করার নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে বলেও আশঙ্কা হয়। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি স্থানীয় সরকার-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করার সুপারিশ করেছে (২৬ নভেম্বর, ২০১০)। সিটি করপোরেশন আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী, ‘সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও, উহা (নির্বাচনের মাধ্যমে) পুনর্গঠিত সিটি কর্পোরেশনের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করিয়া যাইবে।’ অর্থাৎ, বিদ্যমান আইন অনুসারে মেয়র খোকাকে অপসারণের এখতিয়ার সরকারের নেই। এ ছাড়া আইনের ২৫ ধারামতে, প্রশাসক নিয়োগের বিধান শুধু নতুন সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

যে দেশে একের পর এক সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করে, কারণে-অকারণে আইন অমান্য করে এবং আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে, সে দেশে আইনের শাসন আছে দাবি করা কতটুকু যৌক্তিক? আর যেখানে আইনের শাসন থাকে না, সেখানে জঙ্গলের শাসন বা দুঃশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য। আর এর পরিণতিও সাধারণত মঙ্গলজনক হয় না।

এটি আজ সুস্পষ্ট যে, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা এবং উপজেলার মতো নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর করার ব্যাপারে সরকার যেন এক ধরনের লুকোচুরিতে লিপ্ত। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তারা দোদুল্যমানতায় ভুগছে। আর চাপে পড়ে নির্বাচন দিলেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাত-পায়ে তারা শেকল পরিয়ে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সংবিধানবহির্ভূতভাবে এবং আদালতের নির্দেশ [আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বনাম বাংলাদেশ ১৬ বিএলটি (এইচসিডি)(২০০৮)] অমান্য করে উপজেলা পরিষদে সাংসদদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। সম্প্রতি আবার মন্ত্রিসভা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের উপজেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলেও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করা হবে। কারণ, কুদরত-ই-ইলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে বিজ্ঞ বিচারপতিরা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘যদি সরকারি কর্মকর্তা বা তাঁদের তল্পিবাহকদের স্থানীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কাজে নিয়োজিত করা হয়, তা হলে এগুলোকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাখা যুক্তিযুক্ত নয়।’ এ ছাড়া অনির্বাচিত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান নির্বাহী হিসেবে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানের সমতুল্য করার এ অপচেষ্টার শোভনীয়তা নিয়েও অনেকের মনে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে।

স্থানীয় সরকারের নির্বাচন নিয়ে টালবাহানার জন্য অনেকে অবশ্য নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করেন। এ ব্যাপারে কমিশনকে দায়ী করা যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, সংবিধান (অনুচ্ছেদ ১১৯) কমিশনকে শুধু সংসদ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সর্বময় দায়িত্ব দিয়েছে। স্থানীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব সরকারের, যদিও নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন।

ঢাকা সিটি করপোরেশন নিয়ে সরকার টালবাহানা করছে। কারণ, সরকার এটিকে মর্যাদার লড়াই হিসেবে দেখছে। আর এখানেই সমস্যা। নির্বাচন যত দিন রুটিন বিষয়ে পরিণত না হবে, তত দিন নির্বাচনের তারিখ নিয়ে খেলা চলতেই থাকবে। নির্বাচনী ফলাফলকে অযাচিতভাবে প্রভাবিত করার অপচেষ্টাও অব্যাহত থাকবে। কারণ, কোনো নির্বাচনেই, বিশেষত নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে কেউ জিতবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ ছাড়া একটি গণতান্ত্রিক দেশে সারা বছর বিভিন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং এর কিছুতে সরকারি দল জিতবে, কিছুতে হারবে—এটাই স্বাভাবিক। তাই নির্বাচনের দিনক্ষণ আগে থেকেই ঠিক করা থাকলে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ নিয়ে এ ধরনের বেআইনি ও অনৈতিক খেলা বন্ধ হবে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি দুই বছর পর ‘২ নভেম্বর’ প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচন এবং প্রতি চার বছর পর নভেম্বরের ‘প্রথম মঙ্গলবার’ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে দল-নির্বিশেষে আমাদের ‘রুলিং ক্লাস’ বা ক্ষমতাবান গোষ্ঠী যথাসময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণকে ক্ষমতায়িত করার সুযোগ সৃষ্টি করতে সম্মত হবেন কি না, তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে। তবে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, পাকিস্তানের ক্ষমতাধরেরাও বঙ্গবন্ধুর স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের কবর খুঁড়েছিলেন।

পরিশেষে এটি সুস্পষ্ট যে, আমাদের দেশের অধিপতিরা নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা প্রদান এবং একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি গ্রহণে অনীহা প্রকাশের মাধ্যমে জনগণকে ক্ষমতায়িত করার কাজে বেআইনি ও অনৈতিকভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি জনগণের সঙ্গে প্রতারণার সমতুল্য। আর সরকারের এসব অর্বাচীনতার কারণে গণতন্ত্রের ভিত শক্ত হচ্ছে না এবং এর কার্যকারিতাও নিশ্চিত হচ্ছে না; বরং এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকৃতরূপ ধারণ করছে এবং উগ্রবাদের জন্য উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। ফলে ‘স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যা সমাধানে’র পথও—কুদরত-ই-ইলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ মামলার রায় স্থানীয় সরকারকে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছে—প্রশস্ত হচ্ছে না। ‘পল্লিজীবনে গতিশীলতা’ আনা তথা ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ সৃষ্টির দিনবদলের সনদে প্রদত্ত অঙ্গীকারও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কারণ, অধিকাংশ সমস্যাই স্থানীয় এবং এগুলোর সমাধানও স্থানীয়। এ ছাড়া এসব অন্যায় ও অনৈতিকতার পরিণামও অকল্যাণকর হতে বাধ্য।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য।

সূত্র: প্রথম আলো, ৫ ডিসেম্বর ২০১০

Related Post

খানসামা উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাথীদের অংশগ্রহণে মুখোমুখি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিতখানসামা উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাথীদের অংশগ্রহণে মুখোমুখি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত

দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলায় গত ১৩ ফেব্রুয়ারি উপজেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাথীদের অংশগ্রহণে মুখোমুখি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা

আসন্ন নির্বাচন, সংখ্যালঘু সম্পদ্রায়ের নিরাপত্তা এবং করণীয় শীর্ষক সুজন এর নাগরিক সংলাপআসন্ন নির্বাচন, সংখ্যালঘু সম্পদ্রায়ের নিরাপত্তা এবং করণীয় শীর্ষক সুজন এর নাগরিক সংলাপ

নির্বাচন এলেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। এই আতঙ্কের বড় কারন অতীত নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি না করা। এই আতঙ্ক বৃদ্ধি পাওয়ার আর