সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক গোলটেবিল বৈঠক ‘কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দলের সংস্কার’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত

‘কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দলের সংস্কার’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত

roundtable-shujan-009গত ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাব-এর কনফারেন্স রুমে ‘কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দলের সংস্কার’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। গোলটেবিল আলোচনার শুরুতেই বিশিষ্ট রাজনৈতিক সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক-এর আত্মার শান্তি কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
নির্বাচন কমিশন যেমন নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করে জাতির কাছে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে এবং সে রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তেমনিভাবে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষেও এমনি কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ প্রকাশ করা জরুরি উল্লেখ করে ড. বদিউল আলম মজুমদার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেন, তাদের কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে ঘরোয়া রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং জরুরি অবস্থা তুলে নেয়া বা শিথিল করার ব্যাপারে তারা সরকারের কাছে সুস্পষ্ট দাবি উত্থাপন করতে পারে। এছাড়া তিনি রাজনৈতিক দলের সংস্কারের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে জাতি হিসেবে আজ আমাদের সামনে দু’টি গুরুতর সমস্যা – গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সমস্যা আর দ্রুততার সাথে সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সমস্যা। তিনি বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তন্তরের গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিকে ক্ষমতাসীনরা বারবার ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা করেছে এবং শেষ পর্যন্- ধবংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচন এবং নির্বাচন পরবর্তীকালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করার জন্য রাজনৈতিক দলে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রয়োজন। ব্যর্থতার কারণে নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর সংস্কৃতিও গড়ে তোলার আহবান রেখে তিনি আরো বলেন, গণতন্ত্র চর্চার জন্য রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক বিধি-বিধান থাকা আবশ্যক। তাদের নিয়মিত কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়াও জরুরি। কাউন্সিলের মাধ্যমেই গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারণের সিদ্ধান্- গৃহীত এবং নেতৃত্ব নির্বাচিত হওয়া প্রয়োজন। নির্বাচনের ক্ষেত্রে গোপন ব্যালটের বিধান সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য এবং শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের ওপর ‘টার্ম লিমিট’ আরোপন এবং একই ব্যক্তির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দলীয় ও রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণের বিষয়ে যে প্রস্-াবগুলো উঠেছে তাও দলীয় কাউন্সিলে সিদ্ধান্- হওয়া বাঞ্চনীয়। এছাড়া মূল প্রবন্ধে তিনি ১৯৭৬ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে প্রণীত ‘পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশন’ সংস্কার করে রাজনৈতিক দলের জন্য যুগোপযোগি একটি আইন করার কথাও ভাবা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেন।
রাজনৈতিক দলই আমাদের দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে উল্লেখ করে অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদ বলেন, রাজনৈতিক দলের কাঠামো, পরিচালন ব্যবস্থা, সিদ্ধান্-গ্রহণ প্রক্রিয়া, অর্থায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে। তিনি রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে গুণগত পরিবর্তন ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা দেখতে চাই উল্লেখ করে আরো বলেন, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্-রে গণতন্ত্রের সংস্কৃতি না থাকলে এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসা জরুরি উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, যে সর্বাত্মক পরিবর্তন প্রয়োজন তা রাজনৈতিক দল থেকেই শুরু হোক। তাহলে আমরা কার্যকর গণতন্ত্র পাবো। সুস্থ নির্বাচন, কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠা আমাদের সকলেরই লক্ষ্য উল্লেখ করে ড. কামাল হোসেন বলেন, আমরা সবাই চাই রোডম্যাপ অনুসারে নির্বাচন হোক এটা নিয়ে আমরা কোন বিতর্ক চাই না। রাজনৈতিক দলের সংস্কারের বিষয়ে ঐক্যমত্য রয়েছে তাই রাজনৈতিক দলের সংস্কারের জন্য দেরি হবে – এটা আমি চাই না। এ প্রসঙ্গে তিনি, ঐক্যমঞ্চ কর্তৃক প্রণীত এবং ১৪ দলের মহাসমাবেশ থেকে সংস্কারের ইস্যুগুলো নিয়ে যে সকল বিষয়ে ঐক্যমত্য হয়েছিল সেগুলোকে নির্বাচন কমিশন এজেণ্ডা হিসেবে গ্রহণ করতে পারে বলেও মন্-ব্য করেন। জনাব এ.এস.এম শাহাজাহান গণতান্ত্রিক মানসিকতা প্রয়োজন উল্লেখ করে বলেন, সংস্কার বিষয়টি ‘ডু ইট ইওয়সেলফ’-এর বিষয়। এটা প্রাত্যাহিক তাই এটা শুরু করা যাবে না, শেষও করা যাবে না। দল, ব্যক্তি, দেশ সকল কিছুর ক্ষেত্রেই এটি একই রকম। জনাব হাফিজউদ্দিন খান বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, সংস্কার হয়ে গেছে আর প্রয়োজন নেই এটা বলা হলে অন্যায় হবে। তিনি বলেন, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এটা না করলে গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে যাবে।
রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রের পরিবর্তন দরকার, যাতে নমিনেশন বাণিজ্য না হয় উল্লেখ করে বিএনপি একাংশের নেতা জনাব মোফাজ্জল করিম বলেন, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। তিনি বলেন, সংস্কারের চেতনাবোধ দলের মধ্যে থেকেই আসতে হবে এবং এক্ষেত্রে দলের মধ্যে ঐক্যমত্য থাকতে হবে। এছাড়া তিনি প্রত্যেক রাজনীতিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হওয়া জরুরি উল্লেখ করে আরো বলেন, এক্ষেত্রে বিভিন্ন মহল থেকে সাজেশান আসতে পারে। রাজনৈতিক দলের সংস্কারের বিষয়ে আইন করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা আবশ্যক উল্লেখ করে জনাব এনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। এজেণ্ডা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এজেণ্ডা ছাড়া যে কোন আলোচনা, সংলাপ আউটকাম রেখে এগুতে পারে না। সৈয়দ আবুল মকসুদ উপমহাদেশের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চার জন্য দলকে নিয়ে স্টাডি ও বিতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
জনগণের ক্ষমতার একমাত্র ধারক ও বাহক হল রাজনৈতিক দল উল্লেখ করে জনাব সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দলের সংস্কার অবশ্য, অবশ্যই করতে হবে। তবে তার অর্থ এই নয় যে, রাজনৈতিক দলের ইতিহাসকে অস্বিকার করা, রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে কিছু করা এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সচেতন নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, সংস্কার সবাইকে, সকল স্-রে করতে হবে। আওয়ামী লীগ সংস্কারের পক্ষে কি কি করেছে জনাব ফারুক খান সেগুলো সকলের সামনে তুলে ধরে বলেন, আজকে রাজনৈতিক দলের সংস্কার হচ্ছে না এর জন্য নববই ভাগ দায়ী বর্তমান সরকার কারণ তারা রাজনৈতিক দলকে সংস্কার করতে দিচ্ছে না। এক্ষেত্রে তিনি ঘরোয়া রাজনীতিও ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া ও জরুরি আইন শিথীল করার অনুরোধ জানান। জনাব জিএম কাদের বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যেন কর্পোরেট চরিত্রের দল হয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, সংস্কার আমাদের দরকার আর তা করার জন্য কিছুটা হলেও চাপিয়ে দিয়েই সংস্কার করতে হবে। নিবন্ধন আবশ্যক উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, একটি আইন করে যত দ্রুত সম্ভব রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার করা যায় ততই মঙ্গল। জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানিয়ে জনাব সাদেক সিদ্দিকী বলেন, আগে সংস্কার হবে তারপর নির্বাচন হবে। সবচেয়ে বড় সংস্কার হল মাইণ্ডসেটের সংস্কার উল্লেখ করে জনাব তালেয়া রেহমান বলেন, এখনই রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করা দরকার।
‘সুজন’ সভাপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদ-এর সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনায় অন্যান্যদের মধ্যে আরো মতামত তুলে ধরেন ড. আব্দুর রাজ্জাক, জনাব সাদেক সিদ্দিকী, অধ্যাপক হুমায়ুন কবির হিরু, জনাব রেহানা সিদ্দিকী, অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসাইন, অধ্যাপক মাহফুজা খানম, জনাব আহসানুল্লাহ, জনাব নাসরিন বীনা সিকদার, ড. মেহের-ই-খোদা, অধ্যাপক তাপস দেব, জনাব খন্দকার মাহাতাবউদ্দিন, জনাব সুভা সিংহ রায়, জনাব আবু তালেব প্রমুখ। এছাড়া গোলটেবিল আলোচনায় উত্থাপিত ‘সুজন’-এর প্রস্-াবিত বিষয়সমূহের সাথে উপস্থিত সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেন।

Related Post

“সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচনের লক্ষ্যে করণীয়” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত“সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচনের লক্ষ্যে করণীয়” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, সকাল ১০.০০টায় ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর আয়োজনে জাতীয় প্রেস ক্লাব অডিটোরিয়াম এ “সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচনের লক্ষ্যে করণীয়” শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সুজনের নির্বাহী সদস্য

কার্যকর ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় করণীয়কার্যকর ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় করণীয়

উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সাংসদদের কোনো বিরোধ থাকা উচিত নয়। তাঁদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তা না হলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়ে যাবে। গত ২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিকর

‘চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত‘চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

নির্বাচনই যথেষ্ট নয়, উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করার আহ্বান দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার ব্যবস’াকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা আমাদের সাংবিধানিক নির্দেশনা। অথচ স্বাধীনতার ৪৩