সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক গোলটেবিল বৈঠক গণতন্ত্র আজ প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কাছে জিম্মি – গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

গণতন্ত্র আজ প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কাছে জিম্মি – গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা


গত ২৮ মার্চ ২০১২, সকাল ১০ টায়, জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে, সুজনেউদ্যোগে, আমাদের গণতন্ত্র কোন পথে শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদের সভাপতিত্বে বৈঠকে সঞ্চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সুজন সহ-সভাপতি জনাব এম হাফিজ উদ্দিন খান বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ড. কামাল হোসেন, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলাম, রাজনীতিবিদ আব্দুর রব, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, হায়দার আকবর খান রনো, মাহমুদুর রহমান মান্না, নূহ-উল-আলম লেনিন, রুহিন হোসেন প্রিন্স, রাশেদা বেগম হীরা এমপি, অধ্যাপক আহসানুল হক, ড. তোফায়েল আহমেদ, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান, অধ্যাপক কামাল আতাউর রহমান প্রমূখ।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক রওনক জাহান প্রবন্ধে তিনি আইনের শাসন, জবাবদিহিতা ও কণ্ঠ এই তিনটি মানদন্ডের ভিত্তিতে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি বলেন আইনের শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা| আমাদের দেশে বিচার বিভাগ দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত নয়। আনূভুমিক জবাবদিহিতা হচেছ গণতন্ত্রের আর একটি অন্যতম মানদন্ড। কার্যকরী সংসদের এখানে একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যদের সংসদ বর্জনের ধারাবাহিকতা বিদ্যমান এবং তা বিগত সময়ের রেকর্ড সমূহকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে ৮৪% অধিবেশন বর্জন করার মাধ্যমে। গণতন্ত্রের মানদন্ড হিসেবে Voice  (কণ্ঠ) আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। কণ্ঠ বলতে  মূলত ব্যক্তি স্বাধিনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সুশীল সমাজের  স্বাধীনতা নির্দেশ করে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গীকে  স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী সহিষ্ণু নয়। প্রধান দুই দলের মধ্যে বিরাজমান বিরোধ ও বর্জনের রাজনীতি আমাদের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে বড় অন্তরায় বলে তিনি তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর অহমদ বলেন, আমাদের দেশের মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতিতে কোনো বিকল্প খুজে পায় না। তারা মনে করেন, রাজনীতিবিদরাই বিকল্পের ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু রাজনীতিতে এ বিকল্প সৃষ্টি করতে হবে জনগণকে অর্থাৎ এটা আমাদের নাগরিকেদরই কাজ। ড. কামাল হোসেন বলেন, সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, জনগণই ক্ষমতার মালিক। কোথাও বলা হয়নি দুই দল ক্ষমতার মালিক বা তৃতীয় শক্তিও ক্ষমতার মালিক নয়। চাঁদাবাজি, মনোনয়ন বাণিজ্য, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি ইদানিং বহুল ব্যবহৃত ভাষা যা গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না বলে সমালোচনা করেন তিনি। বিচারপতি এবাদুল হক বলেন, গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হলো পরমতসহিষ্ণুতা। আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে এটা লালন করি না। আমরা যদি প্রাথমিক স্তরে গণতন্ত্র চর্চা করতে না পারি তাহলে রাষ্ট্রীয় জীবনে কিভাবে গণতন্ত্র চর্চা করবো। ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেন, ক্ষমতা আরোহনের মাধ্যম হিসেবে গণতন্ত্রকে দেখা হচ্ছে এবং দিন দিন আমাদের জাতীয় সংসদকে নিষ্ক্রিয় অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হচ্ছে। থেকে বের হয়ে আসতে হলে নির্দলীয় দৃষ্টিভঙ্গীর প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন তত্ত্বাবাধায়ক সরকার ব্যবস্থা। আর জন্য নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
জনাব ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, আমরা একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নিবার্চন চাই। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো গ্রহণযোগ্য নিবার্চন হতে পারে না। জনগণ এটা কিছুতেই মেনে নেবে না। হায়দার আকবর খান রনো বলেন, পাঁচ বছর পর নিবার্চন এটাই কি গণতন্ত্র? এই পাঁচ বছরে যদি ক্রসফায়ার, ক্লিন হার্ট, গুম ইত্যাদি চলতে থাকে তাহলে গণতন্ত্র থাকে না। আব্দুর রব বলেন, আমাদের দেশে গণতন্ত্র আদৌ কখনো চর্চা হয়েছে কি? এখানে বহুদিন ধরে চলে আসছে, পরিবারতন্ত্র, লুটপাটতন্ত্র, ফায়দাতন্ত্র, চাটুকারতন্ত্র। মাহমুদুর রহমান মন্না বলেন, গণতন্ত্র আজ প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কাছে জিম্মি। দুই নেতা যা বলবেন তাই আমাদের দেশে গণতন্ত্র। থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন বড় সামাজিক আন্দোলন। গণতন্ত্রের জন্য রয়েছে আমাদের গভীর আবেগ উল্লেখ করে নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, আমি হতাশ নই। গণতন্ত্র আমাদের দেশে ক্রমেই অগ্রসর হচ্ছে। গণতন্ত্র সামপ্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা এক সাথে চলতে পারে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমাদের দেশে লুটপাটের অর্থনীতি বিরাজমান। লুটপাটের অর্থনীতি বিরাজমান থাকলে সেখানে লুটপাটের গণতন্ত্রই চলবে। থেকে পরিত্রাণের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে এমন একটি বিকল্প শক্তির আর্বিভাব প্রয়োজন।   
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণতন্ত্রের কিছু নিয়ম রয়েছে। Democracy is a rule based system. কিন্তু আমাদের দেশে আমরা নির্বাচন সর্বস্ব গণতন্ত্র করে ফেলেছি। একদিনের গণতন্ত্র গণতন্ত্র নয়। এদেশে সবচেয়ে ভালো গণতন্ত্র সেটাই যেটা টাকা দিয়ে কেনা যায়। এর সাথে দুর্নীতিও যুক্ত। তাই এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সর্বস্তরের নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে এবং একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, গণতন্ত্র ও নির্বাচন এক নয়। নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি উপায় মাত্র। আমরা দুটিকে এক করে ফেলি। আমাদের সবকিছু নির্বাচনকেন্দ্রিক। আমাদের কোনো কাজে জবাবদিহিতা নাই। জনাব মিজানুর রহমান খান বলেন, বিচার বিভাগ দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত নয়। সাংবিধানিকভাবে এটা স্বাধীন নয়। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে এখনো সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়নি। অনেক বিষয়ে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত থাকলেও এসকল বিষয়ে কিন্তু তাদের মধ্যে মতৈক্য বিরাজমান।
 

Related Post

“সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচনের লক্ষ্যে করণীয়” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত“সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচনের লক্ষ্যে করণীয়” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, সকাল ১০.০০টায় ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর আয়োজনে জাতীয় প্রেস ক্লাব অডিটোরিয়াম এ “সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচনের লক্ষ্যে করণীয়” শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সুজনের নির্বাহী সদস্য

“সংস্কার প্রস্তাব : বর্তমান ভাবনা” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা“সংস্কার প্রস্তাব : বর্তমান ভাবনা” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা

গত ২২ এপ্রিল, ২০০৭ সকাল ১০ টায় ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাব-এর ভিআইপি লাউঞ্জে একটি গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। “সংস্কার প্রস্তাব : বর্তমান ভাবনা” শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনায় মূল

‘দিনবদলের সনদ জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে’ – গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা‘দিনবদলের সনদ জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে’ – গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

আজ ২৪ জানুয়ারি ২০১৩, সকাল ১০ টায়, জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে, সুজনে’র উদ্যোগে ‘দিনবদলের সনদের চার বছর’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতি জনাব এম হাফিজ উদ্দিন খানের