সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক ড. বদিউল আলম মজুমদার,লেখালেখি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ: সেই ৯১(ই) নিয়ে আবারও বিভ্রান্তি!

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ: সেই ৯১(ই) নিয়ে আবারও বিভ্রান্তি!


বদিউল আলম মজুমদার
গণপ্রতিনিধিত্ব (সংশোধিত) আদেশ ১৯৭২-এর ৯১(ই) ধারা নিয়ে আবারও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তবে এটি পুরোনো কাহিনী। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এটি নিয়ে একবার বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং সব প্রধান রাজনৈতিক দল মিলে এটিকে বাতিল করতেও সফল হয়েছিল। এবার অবশ্য চারদলীয় জোট এটিকে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের একটি শর্ত হিসেবে জুড়ে দিয়েছে, যদিও তাদের প্রবল প্রতিপক্ষ মহাজোটেরও এ ব্যাপারে সমর্থন রয়েছে। আশা করি, দ্রুত বিভ্রান্তিটির অবসান ঘটবে এবং অতীতের ঘটনার আরেকবার পুনরাবৃত্তি এড়ানো যাবে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দাবির অসারতা অনুধাবন করবে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এ গুরুত্বপূর্ণ অর্জনটির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন কমিশনের সুপারিশে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে এই বিধানটি ৯১ডি ধারা হিসেবে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে যুক্ত করে। অধ্যাদেশটি (অধ্যাদেশ-১, ২০০১) জারি করা হয় ৮ আগস্ট ২০০১ তারিখে। এর উদ্দেশ্য ছিল গুরুতর অসদাচরণের কারণে, তদন্তসাপেক্ষে, প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে প্রদান।
দুর্ভাগ্যবশত আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এ বিধানের চরম বিরোধিতা করে এবং এটি বাতিলের জন্য সরকারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। এ চাপের কাছে নতিস্বীকার করে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ২ সেপ্টেম্বর ২০০১ তারিখে জারি করা আরেকটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে (অধ্যাদেশ-২, ২০০১) বিধানটি রহিত করে। এর ফলে নির্বাচন কমিশন, অন্তত মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে, একটি কাগুজে বাঘে পরিণত হয়।
স্মরণ করা প্রয়োজন যে, ১৯ আগস্ট ২০০৮ তারিখে জারি করা একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয়, যার মধ্যে ৯১(ই) সংযোজন ছিল অন্যতম।
৯১(ই)-এর (১) উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো উৎস, প্রাপ্ত প্রতিবেদন, মৌখিক বা লিখিত প্রতিবেদন থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে যদি মনে হয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তাঁর এজেন্ট প্রার্থীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্দেশে বেআইনি কাজে লিপ্ত আছেন বা নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করেছেন এবং এই বেআইনি কাজ প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়া বা প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকার অযোগ্য, তাহলে কমিশন এ ধারার অধীনে যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে। এই উপধারায় আরও বলা হয়েছে, প্রার্থীর কিংবা তাঁর এজেন্টের বিরুদ্ধে বেআইনি কাজের অভিযোগ পেলেই কমিশন তদন্তের নির্দেশ এবং সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে শুনানির সুযোগ দেবে। তদন্ত পরিচালিত হবে জেলা জজ কিংবা প্রায় সমপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে ৯১(ক) ধারার অধীনে নির্বাচনপূর্ব অনিয়ম প্রতিরোধ ও নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গঠিত ‘ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি’ বা নির্বাচনী তদন্ত কমিটি মাধ্যমে, যা আসন্ন নির্বাচনের জন্য ইতিমধ্যে গঠিত হয়েছে।
উপধারা (২)-এ বলা হয়েছে, তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর এবং প্রার্থীর শুনানি শেষে কমিশন যদি নিশ্চিত হয় যে, প্রার্থী বা তাঁর এজেন্ট নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বেআইনি কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল বলে ঘোষণা করতে পারবে। এ প্রক্রিয়ায় প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হলে নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অন্য প্রার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এই উপধারায় আরও বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে যদি কোনো সংসদীয় আসনে শেষ পর্যন্ত একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থাকেন, তাহলে সেই আসনে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-এর ১৭ ধারা অনুযায়ী নির্বাচন বাতিল হবে এবং পরে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
৯১(ই) ধারার বিধানের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনের জন্য নির্বাচনকে রূপক অর্থে একটি ফুটবল খেলার সঙ্গে তুলনা করা যায়। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলাকে সুশৃঙ্খল ও উপভোগ্য করার জন্য একজন রেফারি ও তাঁর সহযোগী দুজন লাইনম্যানের প্রয়োজন হয়। রেফারির কাজ হলো খেলার নিয়ম-কানুনগুলো সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ করা। প্রয়োজনে, গুরুতর অসদাচরণের কারণে, খেলোয়াড়দের লাল-হলুদ কার্ড প্রদর্শন করা হয়। লাল-হলুদ কার্ড প্রদর্শন করা হয় উপর্যুপরি খেলার নিয়ন-কানুন ভঙ্গ কিংবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য। যেমন গত বিশ্বকাপ ফাইনালে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে মাথা দিয়ে আঘাত করার কারণে তারকা খেলোয়াড় জিদানকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রেফারি প্রয়োজনে লাইনম্যানদের পরামর্শ নিয়ে থাকেন।
নির্বাচনী খেলায় নির্বাচন কমিশন রেফারির ভূমিকা পালন করে থাকে। ফুটবল খেলার রেফারি যদি লাল-হলুদ কার্ড দেখানোসহ অসদাচরণের কারণে কোনো খোলোয়াড়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারেন, তাহলে সে খেলা একটি বিশৃঙ্খল, এমনকি সহিংসতার প্রদর্শনীতে রূপান্তরিত হতে পারে। এমন প্রতিযোগিতাকে খেলা না বলে যুদ্ধ বলাই যুক্তিযুক্ত হবে, যার পরিণতি অশুভ হতে বাধ্য। তেমনি নির্বাচন কমিশনকে উপর্যুপরি ও গুরুতর নির্বাচনী বিধি-বিধান লঙ্ঘনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনোরূপ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা যদি না দেওয়া হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হবে এবং নির্বাচনী খেলা অরাজকতায় রূপ নেবে। শুধু সতর্ক করে দেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে কমিশন তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারবে না। আমরা কি তা চাই? সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ঠুঁটো জগন্নাথ নির্বাচন কমিশন কি সহায়ক?
প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশন প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা ইচ্ছা করলেই প্রয়োগ করতে পারবে না। এর জন্য তদন্ত হতে হবে এবং অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। ‘ডিউ প্রসেস’ বা যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। এর পরও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকবে। তাই এ ক্ষমতাটি যথেচ্ছাচারিতার সঙ্গে কমিশনের পক্ষে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না।
অনেকেরই স্নরণ আছে, গত জোট সরকারের আমলে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনের কথা। সব গণমাধ্যম এবং নির্বাচন কমিশনের চোখের সামনে নগ্ন কারচুপির মাধ্যমে চারদলীয় জোট প্রার্থী নির্বাচনে জয়লাভ করেন।
কারচুপির বিষয়টি দেশের এবং দেশের বাইরের গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোও তাদের রিপোর্টে এ অসদাচরণের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরে। তবু নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। এ ব্যর্থতার কারণ হিসেবে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা তাদের ক্ষমতাহীনতার কথা বলেন, যদিও এটি পুরোপুরি সঠিক নয়। এ ছাড়া বাতিল হওয়া ২২ জানুয়ারি ২০০৭ তারিখের নির্বাচনের আগে নির্বাচনী দেয়াল লিখন, তোরণ নির্মাণ, রঙিন পোস্টার ছাপানো, শো ডাউন আয়োজনসহ বিধিবিধান লঙ্ঘনের যে নগ্ন প্রতিযোগিতা চলছিল তা এখনো অনেকেরই স্নৃতিতে আছে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন গত বছরের শেষ দিকে সংস্কার ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপকালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের যে খসড়া ব্যবহার করে তাতে অসদাচরণের অভিযোগে প্রার্থিতা বাতিলের বিধানটি ১০৮ ধারা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। কমিশন কর্তৃক জুন মাসে প্রকাশিত সংলাপের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এ বিধানটি সম্পর্কে কোনো আপত্তি তোলার কথা উল্লেখ নেই। তবে কমিশন সূত্র থেকে জানা যায় যে, কয়েকটি দল মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তের বিরোধিতা করে, কিনতু কমিশনের ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বিরোধিতা দূর হয়। সরকার অবশ্য ইতিমধ্যে মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তের বিধানটি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে।
আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আইনের মাধ্যমে এ ক্ষমতা প্রদান না করা হলেও, বাংলাদেশ সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে অগাধ ক্ষমতা প্রদান করেছে, যে ক্ষমতার বলে কমিশনের পক্ষ থেকে প্রার্থিতা বাতিল, এমনকি নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে কোনো আসনের নির্বাচন বাতিল করাও সম্ভব। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান (superintendence), নির্দেশ (control) ও নিয়ন্ত্রণ (direction) এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকিবে…।’ আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেম এবং অন্যান্য [৪৫ডিএলআর(এডি)(১৯৯৩)] মামলায় বিচারপতি সাহাব উদ্দিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ (যে বেঞ্চে বিচারপতি এম এইচ রহমান, বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি মোস্তফা কামাল ও বিচারপতি লতিফুর রহমান ছিলেন) রায় দেন যে, ?Election Commission?s inherent power under the provision of ?superintendence, control and direction? should be construed to mean the power to supplement the statutory rules with the sole purpose of ensuring free and fair elections.? অর্থাৎ সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা বলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের স্বাভাবিকভাবেই আইনি বিধিবিধানের সঙ্গে সংযোজন করার ক্ষমতা রয়েছে। পরে আপিল বিভাগ আরেকটি মামলায় [মো. আবুল বাশার বনাম কামরুল হাসান ও অন্যান্য, ১৯বিএলডি(এডি)(১৯৯৯)] একই রায় প্রদান করেন।
তাই নির্বাচন কমিশনকে কাগুজে বাঘে পরিণত করার কোনো সুযোগ নেই। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে ৯১(ই) ধারা অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদকেই কার্যকারিতা প্রদান করা হচ্ছে। এ ছাড়া এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে সুস্পষ্ট হবে যে, নির্বাচন কমিশন নিতান্তই একটি ক্ষমতাহীন কাগুজে বাঘ নয়। তাই ৯১(ই) ধারা বাতিলের দাবিটি অযৌক্তিক ও অনৈতিক বলে আমরা মনে করি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন−সুশাসনের জন্য নাগরিক।

তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, ১ ডিসেম্বর ২০০৮

Related Post

সম্পদের হিসাব: মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদসম্পদের হিসাব: মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ

বদিউল আলম মজুমদার সম্পদের হিসাব প্রদানের বাধ্যবাধকতাকে স্থায়িত্ব প্রদানের জন্য এ বিষয়ে একটি আইন প্রণয়ন করাও জরুরি। আইনের মাধ্যমেই সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে বার্ষিকভাবে সম্পদের হিসাব প্রদান না করার জন্য শাস্তির

'সংলাপ-সমঝোতায় দুটো দলেরই আগ্রহ কম''সংলাপ-সমঝোতায় দুটো দলেরই আগ্রহ কম'

নিজস্ব প্রতিবেদক সংলাপ-সমঝোতায় দুটো দলেরই আগ্রহ কম। তারা উভয়ই ক্ষমতা চায়। ক্ষমতায় যাওয়া মানে পাঁচ বছরের জন্য রাজত্ব কায়েম করা। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন যতটুকু করলাম তার জবাবদিহিতার বাইরে থাকা। আর নির্বাচনে হারা