সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক সংবাদ সম্মেলন ‘চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের চালচিত্র’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

‘চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের চালচিত্র’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

????????????????????????????????????

‘আমরা এক বিকৃত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরিলক্ষিত করছি এবং আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছে। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর নেতৃবৃন্দ। আজ ৫ মে ২০১৬ সকাল ১১.০০টায়, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সুজন আয়োজিত ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের হালচাল ও করণীয়’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সুজন নেতৃবৃন্দ এ মন্তব্য করেন।

সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দীন খান। উপস্থিত ছিলেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুজন জাতীয় কমিটির সদস্য জনাব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর এবং সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার প্রমুখ।

লিখিত বক্তব্যে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন জনগণের দৃষ্টি কেড়েছে। কারণগুলোর মধ্যে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানি, মনোনয়ন বাণিজ্যের ব্যাপকতা, রেকর্ড সংখ্যক ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া, একটি বড় রাজনৈতিক দল কর্তৃক অনেক ইউনিয়নে প্রার্থী দিতে না পারা, এক দলকেন্দ্রিক ফলাফল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হামলা-নির্যাতন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এক কথায় বলতে গেলে ব্যাপক অনিয়মের কারণে এই নির্বাচন এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ফলে ব্যাপক সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার ও রাজনৈতিকগুলোও, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।’

নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণহানি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এবার নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত নির্বাচনপূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন পরবর্তী সংঘর্ষ এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক বিরোধের জেরে এ পর্যন্ত ৭১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আহতের সংখ্যা ছয় সহস্রাধিক। প্রাণহানির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, প্রথম ধাপের নির্বাচনের পূর্বে ১০ জন, প্রথম ধাপের নির্বাচনের দিন ১১ জন, প্রথম ধাপের নির্বাচনের পর থেকে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত ১১ জন, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন ৯ জন, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের পর থেকে তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত ১৭ জন, তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন ৫ জন, তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের পর থেকে এ পর্যন্ত ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।’

দিলীপ কুমার সরকার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া সম্পর্কে বলেন, ‘চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যেই সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ইতোপূর্বে ১৯৮৮ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১০০ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে জানা গেছে। প্রথম ধাপ থেকে শুরু করে চতুর্থ ধাপের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ও প্রত্যাহারের পর এই সংখ্যা ১৫০-এ দাঁড়িয়েছে। প্রথম ধাপে ৫৪ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৩৪ জন, তৃতীয় ধাপে ২৯ জন এবং চতুর্থ ধাপে ৩৩ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। এরা সকলেই ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী। অপরদিকে চার ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থীশূন্য ছিল বা আছে মোট ৩৮৮টি ইউনিয়নে। প্রথম ধাপে ১১৯, দ্বিতীয় ধাপে ৭৯ এবং তৃতীয় ধাপে ৮১টি ইউনিয়নে বিএনপি’র প্রার্থীশূন্য ছিল। চতুর্থ ধাপেও ১০৯টি ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী নেই বলে জানা গিয়েছে। অনেক স্থানে ভয়-ভীতি প্রদর্শন, মনোনয়নপত্র জমাদানে বাধা প্রদান, মনোনয়নপত্র কেড়ে নেওয়া বা ছিঁড়ে ফেলার কারণে বিএনপি প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। কেউ কেউ মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও চাপ সৃষ্টির কারণে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন।’

মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘ইউপি নির্বাচনে অস্বাভাবিক হারে ভোট পড়ারও অভিযোগ উঠেছে কোথাও কোথাও। প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৬টি ইউনিয়নে এবং তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে ৭টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে।’

নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রথমবারের মত স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ব্যাপক মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। অধিকাংশ এলাকায় স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে উঠেছে এ অভিযোগ। শুধুমাত্র আওয়ামী লীগেই নয়, বিএনপিতেও মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলীয় একজন সাবেক উপমন্ত্রীর বিরুদ্ধে জমি দলিল করে নেওয়ার বিনিময়ে মনোনয়ন প্রদানের অভিযোগ উঠেছে। আর মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে একদিকে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন কলুষিত হচ্ছে, অন্যদিকে তৃণমূলের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানটির জনকল্যাণমূখী ভূমিকা পালনের সম্ভাবনাও বিনষ্ট হচ্ছে। কেননা, জনকল্যাণে নিবেদিত হওয়া সত্ত্বেও অনেক ভালো মানুষ সম্পদশালী না হওয়ায় মনোনয়ন পাচ্ছেন না।’

মনোনয়ন প্রদানে নারীদের উপেক্ষা সম্পর্কে তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কথা বলে আসলেও বাস্তবে আমরা উল্টো চিত্রটি দেখতে পাই। প্রথম দু দফায় আওয়ামী লীগ মাত্র ১২ জন এবং বিএনপি মাত্র ৬ জনকে চেয়ারম্যান প্রার্থী করে।’ এবারের নির্বাচনে এ পর্যন্ত ১৪ জন নারীর চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি ধাপের নির্বাচনের পূর্বেই প্রতিপক্ষের এজেন্টদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া বা ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া; বুথ দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ভরা; চেয়ারম্যান প্রার্থীর ব্যালটে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা; নির্বাচনী কর্মকর্তা কর্তৃক ব্যালট পেপারে সিল মারা বা সিল মারতে সহায়তা করা; ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের কারণে তিন ধাপে মোট ১৩৯টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। কোনো কোনো ইউনিয়নে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।’

জনাব এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও অনিয়মের ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া চেয়ারম্যান পদে প্রায় ১৫০ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটেছে। এর মাধ্যমে খারাপ নির্বাচনের একটি ট্রেন্ড/নজির সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ। তাই সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।’ মনোনয়ন বাণিজ্য রোধে দলীয় প্যানেল থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা বিকৃত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন লক্ষ করছি। নির্বাচনে সহিংসতা ও অনিয়মের পাশাপাশি বর্তমানে প্রকাশ্যে অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অশনিশঙ্কেত।’ তিনি বলেন, ‘শুধু নির্বাচনের দিনকে বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বললে হবে না। বরং নির্বাচনের আগে-পরে কী ঘটছে, নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হচ্ছে কিনা এবং সবাই প্রার্থী হতে পারছে কিনা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।’

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘দলভিত্তিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কারণে সহিংসতা ও অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। তাই ভবিষ্যতে দলভিত্তিক নির্বাচন করা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে গণমাধ্যমে জোরালো আওয়াজ তোলা দরকার। কারণ আমাদের দলগুলো এখনও দলভিত্তিক নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠেনি।’ তিনি বলেন, ‘শুধু আইন ও ক্ষমতা থাকলেই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ কারা কমিশনে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন এবং নিয়োগপ্রাপ্তরা সদিচ্ছা ও সাহস নিয়ে কাজ করছেন কিনা সেটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়।’

মূল প্রবন্ধ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

Related Post

‘খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের তথ্য উপস্থাপন ও সুজনের দৃষ্টিতে নির্বাচন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত‘খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের তথ্য উপস্থাপন ও সুজনের দৃষ্টিতে নির্বাচন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে সকল অনিয়ম ও ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত হয়েছে নির্বাচন কমিশন তা আমলে নেবে, এগুলোর ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন- করবে; প্রতিটি ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবে

‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেমন জনপ্রতিনিধি পেলাম’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেমন জনপ্রতিনিধি পেলাম’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

খুলনা মডেলে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা ছিল ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’ বলে মন্তব্য করেছেন ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর নেতৃবৃন্দ। তারা আজ ‘সুজন’-এর পক্ষ থেকে ‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেমন জনপ্রতিনিধি

সিটি করপোরেশন নির্বাচন: ২০০৮ ও ২০১৩ প্রার্থীদের তথ্যের তূলনামূলক বিশ্লেষণসিটি করপোরেশন নির্বাচন: ২০০৮ ও ২০১৩ প্রার্থীদের তথ্যের তূলনামূলক বিশ্লেষণ

আগামী ১৫ জুন ২০১৩ তারিখে বরিশাল, খুলনা, সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। চারটি সিটি কর্পোরেশনে সর্বমোট ১২ জন মেয়র প্রার্থী, ১১৮ টি সাধারণ ওয়ার্ডে ৫৪৮ জন