সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক কর্মশালা বরিশালের গৌরনদী উপজেলার দু’টি স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করা ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ‘নাগরিক সংলাপ’ অনুষ্ঠিত

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার দু’টি স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করা ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ‘নাগরিক সংলাপ’ অনুষ্ঠিত

SAM_5411দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, একটি স্বার্থান্বেষী মহল হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে নির্বাচনের সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর এক ধরনের আতংক তৈরি করে। তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়। এ সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে স্থানীয় কিছু সুযোগ সন্ধানী লোক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িগুলো ভাংচুর করে এবং তাদের সম্পদ লুটপাট করে। তাদের নির্যাতনের ভয়ে ভিটেমাটি এবং স্বজন হারানোর ভয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন কুঁকড়ে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা হয়। এমন এক প্রেক্ষাপটে তাদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করাসহ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর উদ্যোগে ২৯ নভেম্বর, ২০১৩ বরিশালের গৌরনদী উপজেলার দু’টি স্থানে ‘নাগরিক সংলাপ’ শীর্ষক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।

 ২.

‘আসন্ন নির্বাচন: নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য’ শিরোনামে প্রথম নাগরিক সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয় ২৯ নভেম্বর সকাল ১০.০০টায় গৌরনদী উপজেলা সদরের কারিতাস মিলনায়তনে। এতে সভাপতিত্ব করেন সুজন গৌরনদী উপজেলার সভাপতি সাংবাদিক জহিরুল ইসলাম জহির। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুজন কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও বরিশাল জেলা কমিটির সভাপতি জনাব আক্কাস হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার ও গৌরনদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সুজন বরিশাল জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজল ঘোষ, সুজন বরিশাল মহানগরী কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুশান্ত ঘোষ ও গৌরনদী প্রেসক্লাবের সভাপতি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান প্রমুখ।

স্বাগত বক্তব্যে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ‘আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী যে সহিংসতা চলছে তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। রাজনীতিবীদদের প্রতি আমাদের আহ্বান – আপনারা সংলাপে বসুন এবং বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করুন।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে। যেমন-সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তথা হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভোট মানেই একটা বিশেষ জনগোষ্ঠীর ভোট। এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনের সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী সহিংসতার শিকার হন। ২০০১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের ওপর সংগঠিত বেশিরভাগ হামলারই কোনো বিচার হয়নি। তাই সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। অথচ এ অপরাজনীতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।’

এ সময় তিনি উপস্থিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা যাতে আপনাদের পছন্দের প্রার্থীকে নিশ্চিন্তে ভোট দিতে পারেন এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সহিংসতার শিকার না হন, সেজন্য আপনাদের ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হতে হবে। প্রগতিশীল যে সকল শক্তি আছে তাদের সহায়তা নিতে হবে। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাগুলো কাজে লাগাতে হবে।’

প্রধান অতিথির বক্তব্যে জনাব আক্কাস হোসেন বলেন, ‘রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। এখানে হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ বলে কিছু নেই, সবাই দেশের নাগরিক। তাই নাগরিক হিসেবে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ভবিষ্যতে যাতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা না হতে পারে সেজন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে ভূমিকা পালন করতে হবে।’

জনাব আবুল কালাম বলেন, ‘আমাদের দেশ বিনির্মাণে সবার ভূমিকা রয়েছে। তাই শুধুমাত্র সংখ্যালঘুর নিরাপত্তাই নয়, বরং সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে আপনারা তথ্য দিলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে তথ্য প্রদানকারীর পরিচয় গোপন রাখা হবে।’

নাগরিক সংলাপে নাগরিকদের মধ্য থেকে মতামত তুলে ধরেন নলছিটি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জিএম হারুন রেজা, প্রবীণ কুমার মল্লিক, প্রভাষক রাজারাম সাহা, শান্তনু ঘোষ, জহিরুল ইসলাম হান্নান, শিক্ষক হুমায়ুন কবীর, নারী কাউন্সিলর শাহনাজ পারভীন প্রমুখ।

সংলাপে অংশ নিয়ে তারা বলেন,

* সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সংক্রান্ত ইস্যুতে সুজন যদি আমাদের পাশে থাকে, তাহলে আমরাও সুজনের পাশে থাকবো।

* ৭১ এ স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা একসাথে ছিলাম। অথচ বর্তমানে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা করছে। আমরা এ দৃশ্য আর দেখতে চাই না।

* সংখ্যালঘু ইস্যুতে ছোট কোনো ঘটনাকেও অনেক সময় মিডিয়া বড় করে প্রচার করে। তখন ঘটনাটি বড় আকার ধারণ করে। তাই এ ব্যাপারে মিডিয়াকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

* আমরা সংখ্যালঘু নই, আমরা সবাই বাংলাদেশি। তাই নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার সমান অধিকার আছে।

* সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন প্রতিরোধে গৌরনদী উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে সুজনের নেতৃত্বে সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি করতে হবে।

* নাগরিক হিসেবে আমরা কাকে ভোট দিবো সে অধিকার আমাদের রয়েছে। তাই এ অধিকার যেন ক্ষুণ্ন না হয় সেজন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

* কোনো ধর্মেই কারও অনিষ্ট করার কথা বলা হয়নি। ইসলাম ধর্মের নবী হযরত মোহাম্মদ সাঃ বিদায় হজ্বের ভাষণে অমুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার করার কথা বলেছেন।

* Majority must be granted, Minority must be respected. আমরা যদি সবাই এটা মেনে নেই তাহলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট থাকবে।

৩.

‘দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করাসহ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে নাগরিক সংলাপ’ শিরোনামে দ্বিতীয় সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয় ২৯ নভেম্বর বিকাল ৩.০০টায় মাহিলাড়া ইউনিয়নের মাহিলাড়া ডিগ্রী কলেজ মিলনায়তনে। এতে সভাপতিত্ব করেন মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুজন কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও বরিশাল জেলা কমিটির সভাপতি জনাব আক্কাস হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।  অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সুজন বরিশাল মহানগরী কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজল ঘোষ ও সুজন গৌরনদী উপজেলার সভাপতি সাংবাদিক জহিরুল ইসলাম জহির প্রমুখ।

স্বাগত বক্তব্যে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ‘হাজার বছর ধরে আমরা হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান একসাথে বসবাস করেছি। নাগরিক হিসেবে আমাদের সংবিধানে সবার অধিকার সমান। সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তবে সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। ভবিষ্যতে যে কোনো নির্বাচনে যাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, সেজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হতে হবে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে জনাব আক্কাস হোসেন বলেন, ‘সুজন বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সুজন চায় সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত একটি দেশ। সেই দেশ গড়তে সবাইকে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আমরা মনে করি এদেশে কেউই সংখ্যালঘু নয়, বরং সবাই স্বাধীন দেশের নাগরিক।’

জবাব কাজল ঘোষ বলেন, ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। একইসাথে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে নাগরিকদেরকে সচেতন, সোচ্চার ও সংগঠিত হয়ে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।’

সাংবাদিক জহিরুল ইসলাম জহির বলেন, ‘সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার কারণে এদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সবার অধিকার সমান। তাই যারা এ অধিকার ক্ষুণ করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে।’

সভাপতির বক্তব্যে সৈকত গুহ পিকলু বলেন, ‘সংলাপের জন্য মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদকে বেছে নেওয়ার সুজনকে ধন্যবাদ জানাই। আমাদের সচেতনতার কারণে বর্তমানে কোনো সহিংসতা নেই। তবে নির্বাচনকে ঘিরে বিশেষ মহল সহিংসতা চালাতে পারে, এজন্য সবাইকে সতর্ক হতে হবে।’

নাগরিকদের মধ্যে সংলাপে অংশ নেন গৌতম লাল ভৌমিক, সুদীপ দাস, এমএম সেকান্দার আলী প্রমুখ। তারা ভবিষ্যতে মাহিলাড়া ইউনিয়নে যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করার অঙ্গীকার করেন।

 প্রতিবেদকঃ নেসার আমিন, সুজন সচিবালয়।

২৯-১২-২০১৩

Related Post

রাজশাহীতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন: নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব শীর্ষক কর্মশালারাজশাহীতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন: নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব শীর্ষক কর্মশালা

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনিশ্চয়তার মুখে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কি হবে তা নিয়ে দেশের বৃহত্তম দু’টি রাজনৈতিক দল এবং তাদের জোট নিজ নিজ অবস্থানে অনঢ়। আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোট

সিলেটে সুজন এর ’সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’ বিষয়ক কর্মশালাসিলেটে সুজন এর ’সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’ বিষয়ক কর্মশালা

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, স্বাধীনতা অর্জনের ৪২ বছর পরও একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাব বাংলাদেশ অনুভব করছে। নির্বাচনকালীন সরকার এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে জনগণ একটি গ্যাড়াকলের

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন: নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব শীর্ষক ঢাকা বিভাগীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিতসুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন: নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব শীর্ষক ঢাকা বিভাগীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বিরাজমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ২ নভেম্বর ২০১৩ সুজন সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত হয় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন: নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব শীর্ষক ঢাকা বিভাগীয় পরিকল্পনা সভা। সভায় সভাপতিত্ব