সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক ড. বদিউল আলম মজুমদার,লেখালেখি সংসদের এখতিয়ার: স্পিকার কি পরোয়ানা জারি করতে পারেন?

সংসদের এখতিয়ার: স্পিকার কি পরোয়ানা জারি করতে পারেন?

palo_logo
বদিউল আলম মজুমদার
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংসদীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত কমিটির তলবে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান দুই কমিশনার ২ জুন অনুষ্ঠিত কমিটির সভায় উপস্থিত হননি। অনুপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি মাননীয় স্পিকারের সঙ্গে বৈঠক করে তাঁকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করে। শোনা যায়, সংসদীয় বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে তিনজনকে কমিটির সামনে হাজির করার অনুরোধ কমিটির পক্ষ থেকে মাননীয় স্পিকারকে করা হয়। স্পিকারের কি এমন ক্ষমতা আছে? সংসদীয় প্রিভিলেজ বলতেই বা কী বোঝায়?
‘পার্লামেন্টারি প্রিভিলেজ’ বা সংসদ ও সাংসদদের অধিকার ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে সংসদের পক্ষ থেকে সাংসদ কিংবা বাইরের কাউকে শাস্তি প্রদানের নজির বহু দেশে রয়েছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি, জেলে প্রেরণ এবং সাংসদদের ক্ষেত্রে, এমনকি সংসদ থেকে বহিষ্কারের ঘটনাও অতীতে অন্য দেশে ঘটেছে। তবে এ ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি একেবারেই শূন্য। তাই এ ক্ষেত্রে অন্য দেশের কনভেনশন বা প্রচলিত প্রথা আমাদের ব্যবহার করতে হবে।
সংসদীয় বিশেষ অধিকার এবং দায়মুক্তির পুরোনো ও সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন এরেসকাইন মে: ‘সংসদের বিশেষ অধিকার হলো কতগুলো স্বতন্ত্র অধিকারের সমষ্টি, যা প্রত্যেক সাংসদ ব্যক্তিগতভাবে এবং সংসদের উভয় কক্ষই উপভোগ করে। এগুলো অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ভোগ করা অধিকারের চেয়ে অতিরিক্ত অধিকার এবং এগুলো ছাড়া সংসদ ও সাংসদেরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম। তাই যদিও বিশেষ অধিকার রাষ্ট্রীয় আইনের অংশ, তবু এগুলোর মাধ্যমে অনেকটা সাধারণ আইনের আওতা থেকে তাঁদের রেহাই দেওয়া হয়।’ আমাদের দেশে অবশ্য উচ্চকক্ষ নেই। তাই উচ্চকক্ষের কথা আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
সংসদীয় বিশেষ অধিকারগুলোকে দুইভাবে বিভাজন করা যায়: কতগুলো এককভাবে সাংসদদের জন্য প্রযোজ্য এবং অন্যগুলো পুরো সংসদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এগুলোকে আরও সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়। যেমন, ব্যক্তি সাংসদদের বেলায় প্রযোজ্য বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তির ক্ষেত্রগুলো হলো: (ক) বাকস্বাধীনতা, (খ) দেওয়ানি মামলায় গ্রেপ্তার থেকে অব্যাহতি, (গ) জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি, এবং (ঘ) সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত হওয়া থেকে অব্যাহতি। এগুলো মূলত দায়মুক্তি সম্পর্কিত অধিকার এবং এগুলোর ফলে ব্যক্তি সাংসদদের স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধির ১৭২-১৭৬ ধারায় এসব বিষয়-সম্পর্কিত বিধান রয়েছে।
পুরো সংসদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অধিকার ও ক্ষমতাগুলো হলো: (ক) শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার অধিকার। কোনো ব্যক্তিকে বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন করার বা সংসদ অবমাননার জন্য শাস্তি প্রদান, যার মধ্যে দুর্নীতি, অপকর্ম ও অসদাচরণের জন্য সাংসদদের বহিষ্কার এ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। সংসদের এ ধরনের অধিকারকে শাস্তিমূলক ক্ষমতা বলা হয়। (খ) সংসদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের ব্যবস্থাপনা বা কার্যপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত ক্ষমতা। (গ) সাংসদদের উপস্থিতি ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করার ক্ষমতা। (ঘ) তদন্ত করার, সাক্ষী ও রেকর্ডপত্র তলব করার ক্ষমতা। আমাদের জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধির ২০১-২০৩ ধারায় এ সম্পর্কিত বিধান রয়েছে। (ঙ) সাক্ষীদের শপথ প্রদানের ক্ষমতা। আমাদের কার্যপ্রণালী-বিধির ২০৪-২০৫ ধারা এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক। (চ) মানহানিকর বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এমন কাগজপত্র প্রকাশ করার ক্ষমতা।
বিষয়টি সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট ধারণা অর্জনের লক্ষ্যে বিশেষ অধিকার (privileges), ক্ষমতা (powers) ও দায়মুক্তির (immunities) মধ্যে বিভাজন করা আবশ্যক; যদিও অনেক সময় তা করা হয় না। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সরকারের মতে, ‘নিজস্ব অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সংসদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে বিশেষ অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কোনো ব্যক্তিকে সংসদের অধিকার ক্ষুণ্ন বা অবমাননার দায়ে শাস্তি দেওয়ার অধিকারকে ক্ষমতা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সংসদে যেকোনো কিছু বলার জন্য কোনো সাংসদ দায়ী না হওয়ার অধিকারই দায়মুক্তি।’ [বিশেষ রেফারেন্স অনুচ্ছেদ ১৪৩, এআইআর (১৯৬৫), এসসি ৭৪৫]
আমাদের সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদে সংসদ ও সাংসদদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তির বিধান রয়েছে: ‘৭৮(১) সংসদের কার্যধারার বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না। (২) সংসদের যে সদস্য বা কর্মচারীর উপর সংসদের কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রণ, কার্য পরিচালনা বা শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষমতা ন্যস্ত থাকিবে, তিনি এই সকল ক্ষমতাপ্রয়োগ-সম্পর্কিত কোন ব্যাপারে কোন আদালতের এখতিয়ারের অধীন হইবেন না। (৩) সংসদে বা সংসদের কোন কমিটিতে কিছু বলা বা ভোটদানের জন্য কোন সংসদ-সদস্যের বিরুদ্ধে কোন আদালতে কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না। (৪) সংসদ কর্তৃক বা সংসদের কর্তৃত্বে কোন রিপোর্ট, কাগজপত্র, ভোট বা কার্যধারা প্রকাশের জন্য কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন আদালতে কোন কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না। (৫) এই অনুচ্ছেদ-সাপেক্ষে সংসদের আইন দ্বারা সংসদের, সংসদের কমিটিসমূহের এবং সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার নির্ধারণ করা যাইতে পারিবে।’
অনুচ্ছেদ ৭৬ সংসদীয় কমিটিগুলোর কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত। যেমন: ‘৭৬(২)(গ) জনগুরুত্বপূর্ণ বলিয়া সংসদ কোন বিষয় সম্পর্কে কমিটিকে অবহিত করিলে সেই বিষয়ে কোন মন্ত্রণালয়ের কার্য বা প্রশাসন সম্বন্ধে অনুসন্ধান বা তদন্ত করিতে পারিবেন এবং কোন মন্ত্রণালয়ের নিকট হইতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহের এবং প্রশ্নাদির মৌখিক বা লিখিত উত্তরলাভের ব্যবস্থা করিতে পারিবেন।’ ‘৭৬(৩) সংসদ আইনের দ্বারা এই অনুচ্ছেদের অধীন নিযুক্ত কমিটিসমূহকে (ক) সাক্ষীদের হাজিরা বলবৎ করিবার এবং শপথ, ঘোষণা বা অন্য কোন উপায়ের অধীন করিয়া তাঁহাদের সাক্ষ্য গ্রহণের; (খ) দলিলপত্র দাখিল করিতে বাধ্য করিবার ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবেন।’
সংবিধানের ৭৬ ও ৭৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আইনের দ্বারা সংসদ ও সাংসদদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি নির্ধারণ ও কার্যকারিতা প্রদান করার কথা থাকলেও, অদ্যাবধি আমাদের জাতীয় সংসদ এ ধরনের কোনো আইন প্রণয়ন করেনি। তবে কার্যপ্রণালী-বিধি, যা সংসদ প্রণীত একটি আইন, সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদকে কার্যকারিতা প্রদানের ক্ষেত্রে অবশ্য প্রযোজ্য।
প্রতিবেশী ভারতে স্পিকার কর্তৃক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির, কারারুদ্ধ করার, এমনকি সংসদ থেকে বহিষ্কারের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৪ সালে কেশব সিং নামে জনৈক ব্যক্তির একটি পুস্তিকা প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে। এটি প্রকাশের পর উত্তর প্রদেশ প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার একজন সদস্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করার এবং পরিষদের অবমাননার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে একটি তিরস্কারাদেশ জারি করেন। একই দিনে একটি অশালীন চিঠি প্রেরণের অভিযোগে স্পিকার জনাব সিংয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি এবং তাঁকে সাত দিনের কারাদণ্ড প্রদান করেন।
পরবর্তীকালে জনাব সিংয়ের অন্তরীণের বিরুদ্ধে অ্যাডভোকেট বি সলোমন উত্তর প্রদেশ হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস দায়ের করেন। দুজন বিচারকের একটি বেঞ্চ জনাব সিংয়ের মুক্তির এবং দ্রুততার সঙ্গে মামলাটির শুনানির নির্দেশ দেন। এ খবর শোনার পর, প্রাদেশিক পরিষদ একটি সংসদীয় প্রস্তাবের মাধ্যমে দুজন বিচারক ও অ্যাডভোকেটের বিরুদ্ধে অবমাননার অভিযোগ আনে এবং তাঁদের অন্তরীণ করার আদেশ দেয়। একই সঙ্গে জনাব সিংকেও পুনরায় কারারুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়।
বিচারকদ্বয় ও অ্যাডভোকেট প্রাদেশিক পরিষদের সিদ্ধান্তের কথা শোনার পর আদালতের দারস্থ হন এবং দাবি করেন যে, তাঁদের বিরুদ্ধে অবমাননার অভিযোগ আনার এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির এখতিয়ার প্রাদেশিক পরিষদের নেই। তাঁরা পরিষদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন এবং পরিষদের আদেশটি স্থগিতের প্রার্থনা করেন। এ অবস্থায় উত্তর প্রদেশ হাইকোর্টের ২৮ জন বিচারকের পূর্ণ বেঞ্চ মাননীয় স্পিকারকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও তা বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকার জন্য একটি নোটিশ জারি করেন।
একই দিনে প্রাদেশিক পরিষদ একটি ব্যাখ্যামূলক প্রস্তাব পাস করে যে, আগের প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদানের পর অবমাননার অভিযোগ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্রস্তাবটির মাধ্যমে বিচারকদ্বয় ও অ্যাডভোকেটের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার এবং তাঁদেরকে পরিষদের সামনে হাজির হয়ে কেন তাঁদেরকে পরিষদ অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না তাঁর ব্যাখ্যা প্রদানেরও নির্দেশ প্রদান করা হয়।
এমনি এক দ্বন্দ্বাত্মক পরিস্থিতিতে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টে একটি রেফারেন্স প্রেরণ করেন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সাত সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের ৬-১ সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে আদালত বলেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যা করতে পারে ভারতীয় পার্লামেন্ট তা পারে না−ভারতীয় পার্লামেন্ট গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারে না। আদালত সুস্পষ্ট অভিমত দেন, ‘…এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে, যদিও সংসদের অগাধ ক্ষমতা রয়েছে, তবু সংসদকে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদের বিধানের আওতার মধ্যে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। লিখিত সংবিধানের আওতায় পরিচালিত একটি গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধানই মুখ্য ও সার্বভৌম…তাই এতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয় যে, ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট যে সার্বভৌমত্ব দাবি করতে পারে, ভারতে কোনো সংসদই আক্ষরিক ও নিরঙ্কুশ অর্থে তা দাবি করতে পারে না।’
স্নরণ রাখা প্রয়োজন, ভারতীয় সংবিধানের ১০৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, এর সদস্য ও কমিটিগুলোর ক্ষেত্রে সংসদীয় বিশেষ অধিকার, ক্ষমতা ও দায়মুক্তির যে বিধান রয়েছে তা ভারতীয় সংসদ, সাংসদ ও কমিটিগুলোর জন্য প্রযোজ্য হবে। একই ধরনের বিধান প্রযোজ্য হবে প্রাদেশিক পরিষদগুলোর ক্ষেত্রেও। (অনুচ্ছেদ ১৯৪ ও ২১২) ভারতীয় সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়ে আরও বলা হয়, ‘সংসদ, বস্তুত ভারতীয় সব আইনপ্রণয়নকারী সংস্থা কখনো কোনো বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। তারা যে তথ্য সংরক্ষণকারী আদালত (Court of Records) তাদের ঐতিহাসিক এবং সাংবিধানিক ঐতিহ্য সে দাবি সমর্থন করে না। তাই যদি হয়, তাহলে ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা একটি ঊর্ধ্বতন (superior) তথ্য সংরক্ষণকারী আদালত কর্তৃক জারি করা পরোয়ানা হিসেবে বিলাতের আদালত যে গণ্য করতে সম্মত হয়েছে, তা বর্তমান (ভারতের) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাই সমঝোতার ভিত্তিতে ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের সাধারণ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির যে ক্ষমতা নিশ্চিতভাবে রয়েছে তা ভারতীয় সংসদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, তা দাবি করা অযৌক্তিক। এ কারণে ভারতীয় সংসদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ক্ষমতা রয়েছে, সে ধারণা প্রত্যাখ্যান করা আবশ্যক।’ অর্থাৎ ভারতীয় আইনসভার ক্ষেত্রে স্পিকারের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ক্ষমতা নেই।
আদালতের এমন রায় সত্ত্বেও মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে ভারতীয় পার্লামেন্ট ১৯৭৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার, জেলে প্রেরণ ও লোকসভা থেকে বহিষ্কার করে। ১৯৮১ সালের ৭ মে লোকসভার আরেকটি প্রস্তাবের মাধ্যমে তাঁর এবং অন্য দুজন সহকর্মীর শাস্তি প্রত্যাহার করা হয়। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, সংসদীয় বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত আইনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির ও সংসদের আগের সিদ্ধান্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। আমাদের জানামতে, এ দুটি সংসদীয় প্রস্তাবের কোনোটিই আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। তাই স্পিকারের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার বিষয়ে ভারতীয় সাংবিধানিক বেঞ্চের ১৯৬৪ সালের সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে বলে ধরে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত।
পরিশেষে, এটি সুস্পষ্ট যে, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সংসদীয় অধিকার ক্ষুণ্ন করার দায়ে কারও বিরুদ্ধে স্পিকারের বা সংসদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির এখতিয়ার নেই বলে অভিমত দিয়েছেন। এ অভিমত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য; কারণ ভারতীয় সংবিধানে সংসদ ও সাংসদদের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এবং তার সদস্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিশেষ ক্ষমতা ও দায়মুক্তির বিধান রাখা হয়েছে। আমাদের সংবিধানে এমন কোনো বিধান নেই এবং নেই কোনো বিশেষ অধিকার নির্ধারণের লক্ষ্যে আইন। তাই আমাদের মাননীয় স্পিকারের কারও বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার ক্ষমতা রয়েছে বলে ধারণা করা অযৌক্তিক। ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন−সুশাসনের জন্য নাগরিক।
তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, ১২ জুন ২০০৯

Related Post

রাজনীতি: নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শিক্ষণীয়রাজনীতি: নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শিক্ষণীয়

বদিউল আলম মজুমদার গত ২৯ ডিসেম্বর, ২০০৮ তারিখে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত চারদলীয় জোটের মহাবিপর্যয় ঘটেছে। সংসদে চারদলীয় জোটের আসনসংখ্যা ২০০১ সালের ২১৪ থেকে (নোয়াখালী-১ আসনসহ) ৩৩টি

তত্ত্বাবধায়ক সরকার: বল এখন রাজনীতিবিদদেরই কোর্টেতত্ত্বাবধায়ক সরকার: বল এখন রাজনীতিবিদদেরই কোর্টে

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ৩১-০৫-২০১১ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি অবৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ১০ মে দেওয়া রায় অনেক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ইতিমধ্যে রায়

অধ্যাপক মোজাফ্ফরকে যেমন দেখেছিঅধ্যাপক মোজাফ্ফরকে যেমন দেখেছি

বদিউল আলম মজুমদার অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে চিনি। তখন তিনি অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। আমি এ খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানে ছাত্র। সে সময়ে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব-মোনায়েমের তাঁবেদাররা অর্থনীতি বিভাগের জনপ্রিয়