সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক ড. বদিউল আলম মজুমদার,লেখালেখি স্পিকার কারও বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন না

স্পিকার কারও বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন না

jugantor_logo
ড. ব দি উ ল আ ল ম ম জু ম দা র
গত ৩০ জুলাই দৈনিক যুগান্তরের হেডলাইন ছিল ‘হাসান মশহুদসহ ৩ জনকে হাজির করবে সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস’। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনটির মূল বক্তব্য হল, পরপর তিন দফা তলব করা সত্ত্বেও গরহাজির হওয়ার কারণে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পদত্যাগী চেয়ারম্যান লে. জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরী, কমিশনার হাবিবুর রহমান ও কমিশনার মঞ্জুর মান্নানকে জাতীয় সংসদের ‘সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত কমিটি’র সভায় হাজির করা হবে। জাতীয় সংসদের সার্জেন্ট অ্যাট আর্মসের মাধ্যমে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের সহায়তায় তা করা হবে। এ ব্যাপারে কমিটির পক্ষ থেকে সংসদীয় বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার জন্য স্পিকারকে পত্র দেয়া হয়েছে। আমাদের স্পিকার কি তা করতে পারেন? সে ক্ষমতা কি তার আছে?

‘পার্লামেন্টারি প্রিভিলেজ’ বা সংসদ ও সংসদ সদস্যদের অধিকার ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে সংসদের পক্ষ থেকে সংসদ সদস্য কিংবা বাইরের কাউকে শাস্তি প্রদানের নজির বহু দেশে রয়েছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি, জেলে প্রেরণ এবং সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে, এমনকি সংসদ থেকে বহিষ্কারের ঘটনাও অতীতে অন্য দেশে ঘটেছে। তবে এ ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি একেবারেই শূন্য। তাই এ ক্ষেত্রে অন্য দেশের কনভেনশন বা প্রচলিত প্রথা আমাদের ব্যবহার করতে হবে।
সংসদীয় বিশেষ অধিকার এবং দায়মুক্তির পুরনো ও সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন এরেসকাইন মে : ‘সংসদের বিশেষ অধিকার হল কতগুলো স্বতন্ত্র অধিকারের সমষ্টি যা প্রত্যেক সংসদ সদস্য ব্যক্তিগতভাবে এবং সংসদের উভয় কক্ষই উপভোগ করে। এগুলো অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ভোগ করা অধিকারের চেয়ে অতিরিক্ত অধিকার এবং এগুলো ছাড়া সংসদ ও সংসদ সদস্যগণ তাদের দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম। তাই যদিও বিশেষ অধিকার রাষ্ট্রীয় আইনের অংশ, তবুও এগুলোর মাধ্যমে অনেকটা সাধারণ আইনের আওতা থেকে তাদের রেহাই প্রদান করা হয়।’ আমাদের দেশে অবশ্য উচ্চকক্ষ নেই, তাই উচ্চকক্ষের কথা আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
সংসদীয় বিশেষ অধিকারগুলোকে দু’ভাবে বিভাজন করা যায়- কতগুলো এককভাবে সংসদ সদস্যদের জন্য প্রযোজ্য এবং অন্যগুলো পুরো সংসদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এগুলোকেও আরও সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়। যেমন : ব্যক্তি সংসদ সদস্যদের বেলায় প্রযোজ্য বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তির ক্ষেত্রগুলো হল : (ক) বাকস্বাধীনতা (খ) দেওয়ানি মামলায় গ্রেফতার থেকে অব্যাহতি (গ) জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি এবং (ঘ) সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত হওয়া থেকে অব্যাহতি। এগুলো মূলত দায়মুক্তি সম্পর্কিত অধিকার এবং এগুলোর ফলে ব্যক্তি সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধির ১৭২-১৭৬ ধারায় এ সব বিষয় সম্পর্কিত বিধান রয়েছে।
পুরো সংসদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অধিকার ও ক্ষমতাগুলো হল : (ক) শৃঙখলা নিশ্চিত করার অধিকার। কোন ব্যক্তিকে বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন করার বা সংসদ অবমাননার জন্য শাস্তি প্রদান, যার মধ্যে দুর্নীতি, অপকর্ম ও অসদাচরণের জন্য সংসদ সদস্যদের বহিষ্কার এ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। সংসদের এ ধরনের অধিকারকে শাস্তিমূলক ক্ষমতা বলা হয়। (খ) সংসদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের ব্যবস্থাপনা বা কার্যপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত ক্ষমতা। (গ) সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করার ক্ষমতা। (ঘ) তদন্ত করার, সাক্ষী এবং রেকর্ডপত্র তলব করার ক্ষমতা। আমাদের জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধির ২০১-২০৩ ধারায় এ সম্পর্কিত বিধান রয়েছে। (ঙ) সাক্ষীদের শপথ প্রদানের ক্ষমতা। আমাদের কার্যপ্রণালী-বিধির ২০৪-২০৫ ধারা এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক। (চ) মানহানিকরবিষয়ক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এমন কাগজপত্র প্রকাশ করার ক্ষমতা।
বিষয়টি সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট ধারণা অর্জনের লক্ষ্যে বিশেষ অধিকার (ঢ়ৎরারষবমবং), ক্ষমতা (ঢ়ড়বিৎং) এবং দায়মুক্তির (রসসঁহরঃরবং) মধ্যে বিভাজন করা আবশ্যক, যদিও অনেক সময় তা করা হয় না। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি সরকারের মতে : ‘নিজস্ব অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সংসদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে বিশেষ অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কোন ব্যক্তিকে সংসদের অধিকার ক্ষুণ্ন বা অবমাননার দায়ে শাস্তি দেয়ার অধিকারকে ক্ষমতা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সংসদে যে কোন কিছু বলার জন্য কোন সংসদ সদস্য দায়ী না হবার অধিকারই দায়মুক্তি।’ [বিশেষ রেফারেন্স অনুচ্ছেদ ১৪৩, এআইআর (১৯৬৫) এসসি ৭৪৫]
আমাদের সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদে সংসদ ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তির বিধান রয়েছে: ‘৭৮(১) সংসদের কার্যধারার বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না। (২) সংসদের যে সদস্য বা কর্মচারীর উপর সংসদের কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রণ, কার্যপরিচালনা বা শৃঙখলা রক্ষার ক্ষমতা ন্যস্ত থাকিবে, তিনি এই সকল ক্ষমতা প্রয়োগ-সম্পর্কিত কোন ব্যাপারে কোন আদালতের এখতিয়ারের অধীন হইবেন না। (৩) সংসদে বা সংসদের কোন কমিটিতে কিছু বলা বা ভোটদানের জন্য কোন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কোন আদালতে কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না। (৪) সংসদ কর্তৃক বা সংসদের কর্তৃত্বে কোন রিপোর্ট, কাগজপত্র, ভোট বা কার্যধারা প্রকাশের জন্য কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন আদালতে কোন কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না। (৫) এই অনুচ্ছেদসাপেক্ষে সংসদের আইন দ্বারা সংসদের, সংসদের কমিটিসমূহের এবং সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার নির্ধারণ করা যাইতে পারিবে।’
অনুচ্ছেদ ৭৬ সংসদীয় কমিটিগুলোর কার্যপরিচালনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত। যেমন : ‘৭৬(২)(গ) জনগুরুত্বপূর্ণ বলিয়া সংসদ কোন বিষয় সম্পর্কে কমিটিকে অবহিত করিলে সেই বিষয়ে কোন মন্ত্রণালয়ের কার্য বা প্রশাসন সম্বন্ধে অনুসন্ধান বা তদন্ত করিতে পারিবেন এবং কোন মন্ত্রণালয়ের নিকট হইতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহের এবং প্রশ্নাদির মৌখিক বা লিখিত উত্তর লাভের ব্যবস্থা করিতে পারিবেন।’ ‘৭৬(৩) সংসদ আইনের দ্বারা এই অনুচ্ছেদের অধীন নিযুক্ত কমিটিসমূহকে (ক) সাক্ষীদের হাজিরা বলবৎ করিবার এবং শপথ, ঘোষণা বা অন্য কোন উপায়ের অধীন করিয়া তাহাদের সাক্ষ্য গ্রহণের; (খ) দলিলপত্র দাখিল করিতে বাধ্য করিবার ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবেন।’
সংবিধানের ৭৬ ও ৭৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের দ্বারা সংসদ ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি নির্ধারণ ও কার্যকারিতা প্রদান করার কথা থাকলেও, অদ্যাবধি আমাদের জাতীয় সংসদ এ ধরনের কোন আইন প্রণয়ন করেনি। তবে কার্যপ্রণালী-বিধি, যা সংসদ প্রণীত একটি আইন, সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদকে কার্যকারিতা প্রদানের ক্ষেত্রে অবশ্য প্রযোজ্য। কার্যপ্রণালী-বিধির ২২তম অধ্যায় সংসদ, সংসদীয় কমিটি এবং ব্যক্তি সংসদ সদস্যের বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত, কিন্তু এতে স্পিকারকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ক্ষমতা দেয়া হয়নি।
প্রতিবেশী ভারতে স্পিকার কর্তৃক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির, কারারুদ্ধ করার, এমনকি সংসদ থেকে বহিষ্কারের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৪ সালে কেশব সিং নামে জনৈক ব্যক্তির একটি পুস্তিকা প্রকাশের প্রেক্ষিতে। এটি প্রকাশের পর উত্তর প্রদেশ প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার একজন সদস্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করার এবং পরিষদের অবমাননার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একটি তিরস্কারাদেশ জারি করেন। একই দিনে নিজেকে একটি অশালীন চিঠি প্রেরণের অভিযোগে স্পিকার জনাব সিংয়ের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি এবং তাকে ৭ দিনের কারাদণ্ড প্রদান করেন।
পরবর্তী সময়ে জনাব সিংয়ের অন্তরীণের বিরুদ্ধে অ্যাডভোকেট বি সলোমন উত্তর প্রদেশ হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস দায়ের করেন। দু’জন বিচারকের একটি বেঞ্চ জনাব সিংয়ের মুক্তির এবং দ্রুততার সঙ্গে মামলাটির শুনানির নির্দেশ দেন। এ খবর শোনার পর, প্রাদেশিক পরিষদ একটি সংসদীয় প্রস্তাবের মাধ্যমে দু’জন বিচারক ও অ্যাডভোকেটের বিরুদ্ধে অবমাননার অভিযোগ আনেন এবং তাদেরকে অন্তরীণ করার আদেশ দেন। একই সঙ্গে জনাব সিংকেও পুনঃকারারুদ্ধ করার নির্দেশ দেন।
বিচারকদ্বয় ও অ্যাডভোকেট প্রাদেশিক পরিষদের সিদ্ধান্তের কথা শোনার পর নিজেরাই আদালতের দ্বারস্থ হন এবং দাবি করেন, তাদের বিরুদ্ধে অবমাননার অভিযোগ আনার এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির এখতিয়ার প্রাদেশিক পরিষদের নেই। তারা পরিষদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন এবং পরিষদের আদেশটি স্থগিতের প্রার্থনা করেন। এমতাবস্থায় উত্তর প্রদেশ হাইকোর্টের ২৮ জন বিচারকের পূর্ণ বেঞ্চ মাননীয় স্পিকারকে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও তা বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকার জন্য মাননীয় স্পিকারকে একটি নোটিশ জারি করেন।
একই দিনে প্রাদেশিক পরিষদ একটি ব্যাখ্যামূলক প্রস্তাব পাস করে, পূর্বের প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত সংশ্লিষ্টদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদানের পর অবমাননার অভিযোগ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রস্তাবটির মাধ্যমে বিচারকদ্বয় ও অ্যাডভোকেটের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার এবং তাদেরকে পরিষদের সম্মুখে হাজির হয়ে কেন তাদের পরিষদ অবমাননার দায়ে দোষীসাব্যস্ত করা যাবে না তার ব্যাখ্যা প্রদানেরও নির্দেশ প্রদান করা হয়।
এমনি এক দ্বন্দ্বাত্মক পরিস্থিতিতে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টে একটি রেফারেন্স প্রেরণ করেন। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের সাত সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের ৬-১ সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে আদালত বলেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যা করতে পারে, ভারতীয় পার্লামেন্ট তা পারে না- ভারতীয় পার্লামেন্ট গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারে না। আদালত সুস্পষ্ট অভিমত দেন যে : ‘ঃএটি মনে রাখা প্রয়োজন যে, যদিও সংসদের অগাধ ক্ষমতা রয়েছে, তবুও সংসদকে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদের বিধানের আওতার মধ্যে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। লিখিত সংবিধানের আওতায় পরিচালিত একটি গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধানই মুখ্য ও সার্বভৌমঃ তাই এতে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয় যে, ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট যে সার্বভৌমত্ব দাবি করতে পারে, ভারতের কোন সংসদই আক্ষরিত ও নিরঙ্কুশ অর্থে তা দাবি করতে পারে না।’
স্মরণ রাখা প্রয়োজন, ভারতীয় সংবিধানের ১০৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, এর সদস্য এবং কমিটিগুলোর ক্ষেত্রে সংসদীয় বিশেষ অধিকার, ক্ষমতা ও দায়মুক্তির যে বিধান রয়েছে তা ভারতীয় সংসদ, সংসদ সদস্য ও কমিটিগুলোর জন্য প্রযোজ্য। একই ধরনের বিধান প্রযোজ্য প্রাদেশিক পরিষদসমূহের ক্ষেত্রেও (অনুচ্ছেদ ১৯৪ ও ২১২)।

ভারতীয় সাবিধানিক বেঞ্চের রায়ে আরও বলা হয় : ‘সংসদ, বস্তুত ভারতীয় সকল আইন প্রণয়নকারী সংস্থা কখনো কোন বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। তারা যে তথ্য সংরক্ষণকারী আদালত (ঈড়ঁৎঃ ড়ভ জবপড়ৎফং) তাদের ঐতিহাসিক এবং সাংবিধানিক ঐতিহ্য সে দাবি সমর্থন করে না। তাই যদি হয়, তাহলে ব্রিটিশ হাউজ অব কমন্সের জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা একটি ঊধর্বতন (ংঁঢ়বৎরড়ৎ) তথ্য সংরক্ষণকারী আদালত কর্তৃক জারি করা পরোয়ানা হিসেবে বিলাতের আদালত গণ্য করতে সম্মত হলেও, তা বর্তমান (ভারতের) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাইঃব্রিটিশ হাউজ অব কমন্সের সাধারণ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির যে ক্ষমতা নিশ্চিতভাবে রয়েছে তা ভারতীয় সংসদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, তা দাবি করা অযৌক্তিক। এ কারণে ভারতীয় সংসদের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ক্ষমতা রয়েছে, সে ধারণা প্রত্যাখ্যান করা আবশ্যক।’ অর্থাৎ ভারতীয় আইনসভার ক্ষেত্রে স্পিকারের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ক্ষমতা নেই।
আদালতের এমন রায় সত্ত্বেও মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে ভারতীয় পার্লামেন্ট কর্তৃক ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭৮ তারিখে গ্রেফতার, জেলে প্রেরণ ও লোকসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তী সময়ে লোকসভার ৭ মে, ১৯৮১ তারিখের আরেকটি প্রস্তাবের মাধ্যমে তার এবং অন্য দু’জন সহকর্মীর শাস্তি প্রত্যাহার করা হয়। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, সংসদীয় বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত আইনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির ও সংসদের পূর্বের সিদ্ধান্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে স্পিকারের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি যাতে ভবিষ্যতে দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহূত না হয় সংসদে আইন করে সে পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া আমাদের জানামতে, দুটি সংসদীয় প্রস্তাবের কোনটিই আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়নি, তাই স্পিকারের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার ভারতীয় সাংবিধানিক বেঞ্চের ১৯৬৪ সালের সিদ্ধান্ত এখনও বহাল রয়েছে।
পরিশেষে, এটি সুস্পষ্ট যে, ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট সংসদীয় অধিকার ক্ষুণ্ন করার দায়ে কারও বিরুদ্ধে স্পিকারের বা সংসদের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির এখতিয়ার নেই বলে অভিমত দিয়েছেন। এ অভিমত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, কারণ ভারতীয় সংবিধানে সংসদ ও সংসদ সদস্যদের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এবং তার সদস্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন বিশেষ ক্ষমতা ও দায়মুক্তির বিধান রাখা হয়েছে। আমাদের সংবিধানে তেমন কোন বিধান নেই এবং নেই কোন বিশেষ অধিকার নির্ধারণের লক্ষ্যে আইন। এ ব্যাপারে জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী-বিধিতেও কিছু বলা নেই। তাই আমাদের মাননীয় স্পিকারের কারও বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার ক্ষমতা রয়েছে বলে ধারণা করা অযৌক্তিক।
প্রসঙ্গত, সংসদীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি দুদকের মামলায় নিম্ন আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত, যদিও সম্প্রতি তিনি হাইকোর্ট থেকে খালাস পেয়েছেন। তবে দুদকের দাবি, তিনি টেকনিক্যাল গ্রাউন্ডে খালাস পেয়েছেন এবং এ ব্যাপারে দুদক আপিল দায়ের করবে। নিঃসন্দেহে কমিটির সভাপতি একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি। অনেক নাগরিকের ধারণা, দুদকের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখন সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ ব্যবহার করে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে বিচারকের আসনে বসেছেন। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসার মতে, তিনি একাধারে জজ, প্রসিকিউটর ও জুরির আসনে বসেছেন। একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে বিচারকের আসনে বসতে পারেন না – এটি একটি অতি পুরনো আইনি প্রথা। তাই অনেকেই কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে ‘মেলাফাইডি ইনটেনশন’ বা অসৎ উদ্দেশ্যের অভিযোগ তুলেছেন। তিনি জনস্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করছেন, যার মাধ্যমে জনগণের করের টাকার অপচয় হচ্ছে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)
তথ্য সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১০ আগষ্ট ২০০৯

Related Post

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কারসুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কার

বদিউল আলম মজুমদার নির্বাচনী অপরাধের প্রায় সবগুলোরই উৎস রাজনৈতিক দল, তাদের মনোনীত প্রার্থী ও দলের নেতাকর্মীরা। দল ও দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই মনোনয়ন বাণিজ্যে লিপ্ত হয়, টাকা দিয়ে ভোট কেনে, পেশিশক্তি

জনগণেরই পায়ের তলায় মাটি নেই!জনগণেরই পায়ের তলায় মাটি নেই!

বদিউল আলম মজুমদার | আপডেট: ০০:০৭, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪ সাম্প্রতিক কালে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।

সুশাসন: বাজেট কি দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণসুশাসন: বাজেট কি দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ

বদিউল আলম মজুমদার অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন। প্রাক্কলিত বাজেটের পরিমাণ ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। উন্নয়ন বাজেট ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু বাজেটটি