আসন্ন নির্বাচন ও নাগরিক প্রত্যাশা


ড. বদিউল আলম মজুমদার
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আমরা আশা করি যে, উপজেলা নির্বাচন হবে। কিন্তু নতুন উপজেলা অধ্যাদেশ নিয়েও আমাদের গুরুতর আপত্তি রয়েছে। গত ৩০ জুন জারি করা অধ্যাদেশ অনুযায়ী শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট এলাকার অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রগণ উপজেলা পরিষদের সদস্য হবেন। অর্থাৎ জনগণের সরাসরি ভোটে কোন ব্যক্তি উপজেলা পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন। ফলে উপজেলা পরিষদ মূলত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিয়ন্ত্রিত একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, যা প্রশাসনের সকল স্তরে পরস্পরের নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সৃষ্টির ধারণার সাথে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ। এ কথা বলার অপেৰা রাখে না যে, এ ধরনের উপজেলা ‘চেকস্‌ এন্ড ব্যালেন্সেস’ বিবর্জিত একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনী আইন ও বিধি-বিধানগুলোকে পরিপূর্ণ ও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। গত দু’টি নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এক্ষেত্রে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার নির্বাচনে প্রার্থিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কমিশন চরম শিথিলতা প্রদর্শন করেছে, যার ফলে অনেক বিতর্কিত প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ও নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এছাড়াও কমিশন প্রার্থীদের প্রদত্ত হলফনামা ও আয়কর রিটার্ন যথাযথভাবে বিচার-বিবেচনা করে তথ্য গোপনকারী বা অসত্য তথ্য প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে, যদিও এ ব্যাপারে আদালত থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। এমনকি কমিশন প্রার্থীদের প্রদত্ত তথ্যগুলো যথাসময়ে প্রকাশও করতে পারেনি। এছাড়াও কমিশন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহরের পর শুধুমাত্র চূড়ান্ত প্রার্থীদের তথ্য প্রকাশ করছে, মনোনয়নপত্র জমা দেয়া সকল প্রার্থীর নয়। উপরন্তু নির্বাচন পরবর্তীকালে বেশ কয়েকজন নির্বাচিত প্রতিনিধির বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের গুরুতর অভিযোগ উঠলেও, কমিশন অদ্যাবধি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি। আশা করি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন ভবিষ্যতে আরো কার্যকর ও সাহসি ভূমিকা রাখবে। আশার কথা যে, গত ১৪ সেপ্টেম্বর একদল সচেতন নাগরিকের সাথে বৈঠকের প্রেক্ষিতে কমিশন প্রার্থীদের তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মনোনয়নপত্র জমাদানকারী সকল প্রার্থীর প্রদত্ত হলফনামা, নির্বাচনী ব্যয়ের উৎসের বিবরণী ও আয়কর রিটার্নের কপি মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সাথে সাথে সেগুলো প্রকাশ করা যার অন্যতম। আশা করি, কমিশন এ সিদ্ধান্ত পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করবে এবং যথার্থ যাচাই-বাছাইয়ের পর অসত্য তথ্য প্রদানকারী ও তথ্য গোপনকারীদের মনোনয়নপত্র বাতিল করবে। একইসাথে আমরা দাবি করছি যে, নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধানগুলো – শুধু আক্ষরিক অর্থেই নয়, এর চেতনাও – পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করবে। আমরা অতীতের মতো সাক্ষী গোপাল নির্বাচন কমিশন দেখতে চাই না!
অতীতের নির্বাচনগুলোতে অবাধে টাকার খেলা চলেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন ও পৌর নির্বাচনেও অবৈধ লেনদেন ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে, যদিও তা বহুলাংশে গোপনে ঘটেছে। আমাদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে কলুষমুক্ত করতে হলে নির্বাচনে টাকার প্রভাব দূরীভূত করার এবং নির্বাচনী ব্যয় আইনে নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখার কোন বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশনকেই এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। এ ব্যাপারে নির্বাচনী ব্যয় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণের জন্য অডিটর নিয়োগ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য যে, ১৯৯৩ সালে অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক ও সিকিমের প্রাদেশিক নির্বাচনকালে প্রার্থীদের দৈনন্দিন নির্বাচনী ব্যয় মনিটরিং-এর লক্ষ্যে টিএন সেশনের নেতৃত্বে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন এমনইভাবে অডিটর নিয়োগ করেছিল। প্রসঙ্গত, প্রার্থীদের হলফনামা ও আয়কর রিটার্নে প্রদত্ত তথ্য যাচাইয়ের জন্য প্রতি নির্বাচনী এলাকায় দু’জন অফিসার নিয়োগ করা হবে বলে আমাদের নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি যে ঘোষণা দিয়েছে, সে অফিসারগণই নির্বাচনের সময় অডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এছাড়াও নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে এবং রিটার্নিং অফিসারদের পরিচালনায় নির্বাচনী ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্যে প্রজেকশন মিটিং-এর আয়োজন করা যেতে পারে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র দু’মাস বাকী। এই সময় রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ সকলের কাম্য। আমরা আশা করি যে, আর কালক্ষেপণ না করে দলগুলো নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিবন্ধিত হবে, যাতে তারা একটি আইনী কাঠামোর মধ্যে আসে। নিবন্ধনের ফলে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার পথ সুগম হবে, দলের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে এবং দলের প্রাথমিক সদস্যদের কাছে দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হবে। দলের নিবন্ধনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে অনেক বড় ধরনের, এমনকি অনাকাঙিক্ষত পর্যায়ের ছাড় দিয়েছে এবং আরো ছাড় দেয়ার জন্য কমিশনের ওপর চাপ দেয়া কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আশা করি যে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ত্যাগ করে নির্বাচনী প্রস্তুতিতে নেমে পড়বে।
দলের সাথে সম্পৃক্ত সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোন দলই এখন পর্যন্ত ব্যবস্থা নেয়নি। আশা করি, তারা এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। আমরা আরো আশা করি যে, তারা চিহ্নিত দুর্বৃত্তদের, আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হোক আর না হোক, মনোনয়ন দেবে না। তারা মনোনয়ন বাণিজ্য এবং এ ধরনের অনৈতিক কর্ম থেকে বিরত থাকবে। তারা তৃণমূলের দলীয় সদস্যদের সুপারিশের ভিত্তিতে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেবে। আমাদের প্রত্যাশা যে, দলগুলো সম্ভাব্য প্রার্থীদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবে এবং কতগুলো সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ মানদণ্ডের ভিত্তিতে মনোনয়ন প্রদান করবে। আমাদের আরো প্রত্যাশা যে, দলগুলো প্রার্থীদের প্রদত্ত তথ্য এবং মনোনয়নের মানদণ্ড ও তা কীভাবে প্রয়োগ হয়েছে সে তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করবে। সর্বোপরি, নাগরিক হিসেবে আমাদের আকাঙৰা যে, আইনে অন্তর্ভুক্ত সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো পরিপূর্ণ আন্তরিকতার পরিচয় দেবে, কারণ তাদের সদিচ্ছার ওপরই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল।
সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সচেতন নাগরিক ও সংশিস্নষ্ট সংগঠনগুলোরও অনেক করণীয় রয়েছে। তারা সৎ ও যোগ্য প্রার্থীর পক্ষে সোচ্চার হতে পারেন এবং সজ্জনদেরকে মনোনয়ন প্রদানের লৰ্যে রাজনৈতিক দলের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন। তারা প্রার্থীদের প্রদত্ত তথ্য ভোটারদের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন, যাতে ভোটাররা জেনে-শুনে-বুঝে সুজনে’র পক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। রাজনৈতিক সংস্কার আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রেও সচেতন নাগরিক ও প্রগতিশীল সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
পরিশেষে, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রেখে এটিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় এবং রাষ্ট্রে সুশাসন কায়েম করতে হলে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক ঘোষিত নির্ধারিত দিনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন বিকল্প নেই। নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও অর্থবহ করার মাধ্যমে আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গুণগত মানে পরিবর্তন ঘটানোর এবং আমাদের রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার ক্ষেত্রে সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল এবং সচেতন নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে, এক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক দলের সদাচরণ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। দুর্বৃত্ত ও বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত বিতর্কিত ব্যক্তিরা নির্বাচিত হয়ে যেন গণতন্ত্র ও দেশের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করতে না পারে, এজন্য তাদেরকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে হবে এবং সৎ, দক্ষ ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আশা করি, সংশ্লিষ্ট সকলেই এ ব্যাপারে যথাযথ ভূমিকা পালন করে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সামনে এগিয়ে নেবেন। (সমাপ্ত)
[লেখক : সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক]
তথ্য সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ অক্টোবর ২০০৮

Related Post

নির্বাচনী ইশতেহারের জন্য বিবেচ্য বিষয়সমূহনির্বাচনী ইশতেহারের জন্য বিবেচ্য বিষয়সমূহ

ড. বদিউল আলম মজুমদার প্রত্যেক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক দলগুলো প্রথাগতভাবে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। নির্বাচন পরবর্তীকালে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো কী করবে তারই রূপরেখা হলো নির্বাচনী ইশতেহার।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচন ২০২০ পরবর্তী মূল্যায়ন ও বিজয়ীদের তথ্য বিশ্লেষণঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচন ২০২০ পরবর্তী মূল্যায়ন ও বিজয়ীদের তথ্য বিশ্লেষণ

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখ সকাল ১১.০০টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক- এর উদ্যোগে ‘ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজয়ীদের তথ্য উপস্থাপন ও নির্বাচন মূল্যায়ন’

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অশগ্রহণকারী প্রার্থীগণের তথ্যের বিশ্লেষণ (বিস্তারিত প্রতিবেদন)দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অশগ্রহণকারী প্রার্থীগণের তথ্যের বিশ্লেষণ (বিস্তারিত প্রতিবেদন)

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৫ জানুয়ারি, ২০১৪ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ৩০০ সংসদীয় আসনে সর্বমোট ১১০৭ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা