‘উপজেলা আইন’ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা


ড. বদিউল আলম মজুমদার
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) অধ্যাদেশ, ২০০৮’ জারি করা হয়। নবনির্বাচিত সরকার এ অধ্যাদেশকে অনুমোদন না করে একটি নতুন আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, সরকার ১৯৯৮ সালের ‘উপজেলা পরিষদ আইনে’ দুটি ভাইস চেয়ারম্যান পদের বিধান যুক্ত করে তা পুনর্বহালের উদ্যোগ নিয়েছে। ১৯৯৮ সালের আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫-এর অধীন একক আঞ্চলিক এলাকা হইতে নির্বাচিত সংসদ সদস্য পরিষদের উপদেষ্টা হইবেন এবং পরিষদ উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ করিবে।’ অর্থাৎ আইনের এই বিধানটি কার্যকর হলে উপজেলা পরিষদ সংসদ সদস্যদের কর্তৃত্বে পরিচালিত হবে। সংশিস্নষ্ট সংসদীয় কমিটি উপজেলা পরিষদে সাংসদদের কর্তৃত্ব বহাল রেখে ইতোমধ্যেই তাদের সুপারিশ পেশ করেছে। শোনা যায়, কমিটি স্থানীয় সরকারের অন্যান্য স্তরেও সংসদ সদস্যদের যুক্ত করার পক্ষে মতামত প্রদান করেছে।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে সংসদ সদস্যদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এ উদ্যোগে ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিকে’র পক্ষ থেকে আমরা উদ্বিগ্ন। আমাদের উদ্বেগের কারণ হলো:
একটি আধুনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সকল সরকারি ক্ষমতা তিনটি বিভাগের – নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগ-এর ওপর ন্যাস্ত। বহু শত বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে সৃষ্ট ক্ষমতার বিভাজনের এ নীতির (principles of separation of powers) ফলে সরকার পরিচালনায় ‘চেকস্‌ এন্ড ব্যালেন্সেস’ (checks and balances) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। এ নীতির কারণে প্রত্যেক বিভাগের কাজ সুনির্দিষ্ট করা থাকে এবং তারা স্বাধীনভাবে কাজ করে। তারা একে অপরের কাজে হস্তক্ষেপ করে না, যদিও তারা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদে মাননীয় সংসদ সদস্যদের কার্যপরিধি সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। তাঁদেরকে ‘আইনপ্রণয়ন-ক্ষমতা’ প্রদান করা হয়েছে। নতুন আইন তৈরি, বিদ্যমান আইনে পরিবর্তন ও সংশোধন এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়াও মন্ত্রীপরিষদ সংসদের কাছে দায়বদ্ধ (অনুচ্ছেদ ৫৫) এবং সাংসদদের রয়েছে সরকারের আর্থিক সিদ্ধান্ত অনুমোদনের (অনুচ্ছেদ ৮০) ক্ষমতা।
আমাদের সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের ওপর ‘স্থানীয় শাসনের’ ভার অর্পণ করা হয়েছে, যা নির্বাহী দায়িত্ব। আরো সুস্পষ্টভাবে, তাঁদেরকে প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারিদের কার্যপরিচালনা, জনশৃঙখলা রক্ষা, ‘পাবলিক সার্ভিস’ বা সকল জনকল্যাণমূলক সেবা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ স্থানীয় উন্নয়ন ও স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের।
আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক এবং সংবিধান যাঁদেরকে জনগণের পক্ষে যে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা প্রদান করেছে, তাঁরা সে সকল দায়িত্বই পালন করবেন। তাই ‘আইনপ্রণয়ন-ক্ষমতা’প্রাপ্ত মাননীয় সংসদ সদস্যগণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্তৃত্ব গ্রহণ করলে এবং স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রমে যুক্ত হলে তা হবে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙঘন। আমাদের আইন প্রণেতারা যদি সাংবিধানিক নির্দেশনা উপেক্ষা করে আইন ভঙ্গকারীতে পরিণত হন, তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।
সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে সার্বভৌম সংসদকে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়িত্ব নির্ধারণের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু সংসদে পাস করা আইন সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। ‘কুদরত-ই-এলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ’ মামলার সর্বসম্মত রায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, Parliament is not free to legislate on local government ignoring Articles 59 and 60.’ [Kudrat-E-Elahi Panir Vs. Bangladesh, 44DLR (AD) (1992)]
সংসদ সদস্যদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান ‘কুদরত-ই-এলাহী বনাম বাংলাদেশ’ মামলার রায়ের সঙ্গে আরেকভাবেও অসঙ্গতিপূর্ণ। বিজ্ঞ আদালত তার রায়ে বলেছেন, ‘যদি সরকারি কর্মকর্তা কিংবা তাদের তল্পিবাহকদের (henchmen) স্থানীয় সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়, তাহলে সেগুলোকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান বলা যাবে না।’ সংসদ সদস্যদের সম্পৃক্ততায় সৃষ্ট স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। কারণ এটি হবে সংবিধান বহির্ভূত একটি তথাকথিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, কারণ মাননীয় সংসদ সদস্যগণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নির্বাচিত নন।
আমাদের আশঙ্কা যে, আইনের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের স্থানীয় সরকারের কর্তৃত্ব দেয়া হলে তা হবে, ‘কালারেবল লেজিসলেশন’ (colourable legislation) বা কালো আইন। প্রত্যক্ষভাবে যা করা যায় না, পরোক্ষ্যভাবে তা করলে তাকে ’কালারেবল লেজিসলেশন’ বলা হয়। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের অধীনে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টা করে উপজেলা পরিচালনার দায়িত্ব দিলে তা কালো আইন না হয়ে পারে না। আমাদের আশঙ্কা যে, এ ধরনের আইন ভবিষ্যতে ‘কালাকানুন’ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
যদি মাননীয় সংসদ সদস্যদেরকে উপদেষ্টা করে উপজেলা পরিষদের ওপর তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়, তা গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গেও অসঙ্গতিপূর্ণ হবে। কারণ এ ব্যবস্থায় সাংসদের কর্তৃত্ব থাকবে, কিন্তু দায়বদ্ধতা থাকবে না। এছাড়াও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ গণতন্ত্রের ‘খুঁটি’ স্বরূপ, আর আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই বলা যায়, খুঁটিহীন গণতন্ত্র টিকে থাকে না।
সাংসদদের স্থানীয় পর্যায়ে অনুপস্থিতির কারণে স্থানীয় সরকারের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে। আর ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জনগণের ক্ষমতায়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা ব্যাতীত সম্ভব নয়। কারণ অধিকাংশ সমস্যাই স্থানীয় এবং এগুলো স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে এবং জনগণের সম্পৃক্ততায় সমাধানের কোন বিকল্প নেই। তাই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দুর্বল হলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দিন বদলের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সংকট দেখা দেবে বলে অনেকের আশঙ্কা।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ নেতৃত্ব বিকাশের সূতিকাগার স্বরূপ। তাই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা র্দ্‌বুল হবার মাধ্যমে নেতৃত্ব বিকাশের পথও রুদ্ধ করবে, যা আমাদের সম্ভাবনা বাস্তবে রূপায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ সকল সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে নেতৃত্ব।
মাননীয় সংসদ সদস্যগণ স্থানীয় প্রশাসন ও উন্নয়নে যুক্ত হলে তা জাতীয় সংসদকেও অকার্যকর করে তুলতে পারে। কারণ এর ফলে সাংসদগণ সংসদীয় কার্যক্রমের পরিবর্তে স্থানীয় বিষয়েই বেশি মনোযোগী হয়ে যেতে পারেন। ইতোমধ্যেই জাতীয় সংসদে ব্যাপক অনুপস্থিতি, এমনকি কোরাম সংকট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এছাড়াও সংসদের মানোন্নয়নের জন্য ভবিষ্যতে আইন প্রণয়নে আগ্রহী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাংসদদের স্থানীয় প্রশাসন ও উন্নয়নে যুক্ত হওয়ার ফলে সে পথ অনেকটা রুদ্ধ হয়ে যাবে বলে আমাদের আশঙ্কা।
মাননীয় সাংসদদের স্থানীয় উন্নয়নে সম্পৃক্ত করার পৰে একটি বড় যুক্তি হলো যে, এর মাধ্যমে তাঁরা নির্বাচকদেরকে সেবা ও সহায়তা প্রদানের (constituency) সুযোগ পাবেন। পশ্চিমের সকল গণতান্ত্রিক দেশেই এ ধরনের সুযোগ প্রদান করা হয়। কিন্তু নির্বাচকদের সহায়তা প্রদান করতে গিয়ে তাঁরা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করেন না এবং তা করা সে সকল দেশে গ্রহণযোগ্যও নয়।
মাননীয় সংসদ সদস্যদেরকে উপজেলা পর্যায়ে যুক্ত করার আরেকটি জটিলতা হলো যে, উপজেলার সংখ্যা ৪৮১টি হলেও মাননীয় সংসদ সদস্যদের সংখ্যা মাত্র ৩০০। এ ছাড়াও কিছু উপজেলায় একাধিক সাংসদ রয়েছেন। উপরন্তু, এ ৰেত্রে সংরৰিত আসনের নারী সাংসদদের ভূমিকা কী হবে? কারণ তাদের কোনো নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা নেই।
১৯৯৮ সালের উপজেলা আইনকে পুনর্বহাল করার বিরুদ্ধে আরেকটি বড় যুক্তি হলো, এর মাধ্যমে উপজেলা পরিষদের ওপর আমলাতন্ত্রের খবরদারি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। আইনের ৫০ ও ৫১ ধারায় উপজেলা পরিষদের কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ৰমতা সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া আইনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের স্বায়ত্তশাসন ও ক্ষমতা খর্বকারী আরও অনেক বিধান রয়েছে।
পরিশেষে, মাননীয় সংসদ সদস্যদের স্থানীয় বিষয়ে সম্পৃক্ত হওয়ার অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য সুখকর নয়। গত সরকারের আমলে এ ধরনের সম্পৃক্ততার ফলে সরকার দলীয় সাংসদের অনেকে তাঁদের দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে এক ধরনের ‘এমপি সরকার’ বা ‘এমপি রাজ’ গড়ে তোলেন। এ ধরনের ‘এমপিতন্ত্র’ শুধু ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে পরিণতই করেনি, একইসঙ্গে বিরাজমান প্রশাসনিক কাঠামোকেও বহুলাংশে অকার্যকর করে ফেলে। এর মাশুল অবশ্য তাঁদেরকে দিতে হয়েছে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। প্রস্তাবিত ‘উপজেলা আইন’টি পাশ হলে উপজেলা পরিষদও অকার্যকর হয়ে পড়বে। এ ছাড়াও এর ফলে অনেক এলাকায় স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বিস্তৃতি ঘটবে। একইসাথে অনেক এলাকায় দ্বন্দ্বেরও সৃষ্টি হবে, যা কোনোভাবেই কল্যাণকর হবে না।
লেখক: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
তথ্য সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ এপ্রিল ২০০৯

Related Post

সুশাসন: নেতৃত্ব আর কর্তৃত্ব এক নয়সুশাসন: নেতৃত্ব আর কর্তৃত্ব এক নয়

বদিউল আলম মজুমদার আমাদের দেশে প্রায়ই নেতৃত্বের শূন্যতা ও ব্যর্থতা নিয়ে অভিযোগ শোনা যায়। সম্প্রতি আমার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সুযোগ হয়। সেখানেও আমি একই প্রশ্নের মুখোমুখি হই। ফলে নেতৃত্ব নিয়ে আমার

সুশাসন: সম্পদের হিসাব ও একটি সুপারিশসুশাসন: সম্পদের হিসাব ও একটি সুপারিশ

বদিউল আলম মজুমদার সম্পদের হিসাব প্রকাশ করলেই হবে না, সত্যিকারের স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের জন্য যথাযথ আচরণবিধি প্রণয়ন এবং তা মানা বাধ্যতামূলক করতে

বিশেষ অধিকার, ক্ষমতা ও দায়মুক্তি: কী এবং কেন?বিশেষ অধিকার, ক্ষমতা ও দায়মুক্তি: কী এবং কেন?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সংসদ ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার এবং দায়মুক্তির ধারণার উৎপত্তি যুক্তরাজ্যে। শোনা যায়, এককালে ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের গ্যালারিতে গোয়েন্দারা বসে থাকত এবং কারা রাজার বিরুদ্ধে