ড. বদিউল আলম মজুমদার
আমাদের জাতীয় সংসদে ৩৪৫ জন সদস্য রয়েছেন। তার মধ্যে ৩০০ জন সরাসরি এবং ৪৫ জন সংরক্ষিত আসন থেকে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত। সংসদ কার্যকর হওয়ার জন্য সবারই ভূমিকা রাখা আবশ্যক। সংসদকে কার্যকর করতে হলে সব সংসদ সদস্যের যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। মোটা দাগে সংসদ সদস্যদের কাজ ৪টি। প্রথমত, আইন প্রণয়ন; দ্বিতীয়ত, জাতীয় এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠান; তৃতীয়ত, সরকারের আয়-ব্যয় ও বাজেট অনুমোদন; চতুর্থত, সংসদীয় কমিটিগুলোর মাধ্যমে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ। একক আঞ্চলিক এলাকা থেকে বা সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের মতো সংরক্ষিত আসন থেকে ‘নির্বাচিত’ নারী সদস্যরাও একই ভূমিকা পালন করতে পারেন- যদি তারা আগ্রহী হন এবং সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করতে চান।
আইন প্রণয়ন বলতে সাধারণত আইন পাস করা, পরিবর্তন করা, সংশোধন করা ও বাতিল করাকে বোঝায়। এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি যথাযথভাবে সম্পাদনের জন্য যে প্রস্তুতি দরকার তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব সংসদ সদস্য নিতে পারেন। তাই সংরক্ষিত নারী আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ইচ্ছা করলেই এসব কাজে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতে পারেন।
জাতীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে গঠনমূলক বিতর্কে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। এজন্য সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের এ কাজে অংশগ্রহণ ও অবদান রাখার ক্ষেত্রে কোনরকম বাধা নেই। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় লেখাপড়া ও প্রস্তুতির জন্য অবশ্য তাদের সময় ও শ্রম দিতে হবে।
দুর্ভাগ্যবশত, একক আঞ্চলিক এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মতো সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত সদস্যদের গঠনমূলক বিতর্ক অনুষ্ঠানে আগ্রহ নেই। তারাও প্রতিপক্ষকে কটূক্তি ও নিজ দলের নেতানেত্রীর বন্দনা করতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জাতীয় সংসদের সদ্যসমাপ্ত অধিবেশন। এ কাজে অবশ্য তাদের অবদান রাখা বহুলাংশে নির্ভর করে সরকারের উদারতা ও স্পিকারের নিরপেক্ষতার ওপর। যদি সংসদে উত্থাপিত মুলতবি প্রস্তাবগুলো সরকারের অনুদার এবং স্পিকারের নিরপেক্ষহীনতার কারণে আলোচনা করতে দেয়া না হয়, তাহলে তাদের, বিশেষত বিরোধী দলের সদস্যদের অবদান রাখার পরিসর সীমিত হয়ে পড়ে।
সংসদে মুলতবি প্রস্তাবের ওপর আলোচনার বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা ইতিবাচক নয়। উদাহরণস্বরূপ, গত ২০ বছরে প্রায় ১০ হাজার মুলতবি প্রস্তাব পেশ করা হলেও মাত্র চারটি সংসদে আলোচিত হয়েছে। তাও একমাত্র ৫ম (১৯৯১-৯৬ সালের) সংসদে। গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমান সংসদের চতুর্থ অধিবেশনেও প্রায় শ’খানেক মুলতবি প্রস্তাব পেশ করা হয়, যার একটির ওপরও আলোচনা হয়নি।
সরকারের আয়-ব্যয় ও বাজেট অনুমোদনের ক্ষেত্রেও সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা নেই। এজন্য প্রয়োজন তাদের ঐকান্তিকতা এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি।
সংসদ সদস্যদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। এসব কমিটি যতটুকু কার্যকর, সংসদও ততটুকু কার্যকর। এ কাজে যথাযথ ভূমিকা রাখার জন্য সংসদ সদস্যদের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়। সংশ্লিষ্ট দলিল-দস্তাবেজ পর্যালোচনা করে এর ভিত্তিতে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্থাপন করতে হয়। সংসদ সদস্যরা মনোযোগী হলেই তাদের পক্ষে এ কাজে অবদান রাখা সম্ভব। এ ক্ষেত্রেও সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের ভূমিকা রাখতে কোনরকম বাধা নেই। দুর্ভাগ্যবশত, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের সংসদ সদস্যরা সংসদীয় কমিটির কাজে নিবিষ্টতা প্রদর্শন করেন না। এ কাজের প্রস্তুতিতে তারা সময় দেন না। স্থায়ী কমিটির সদস্য না হয়েও সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরা সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিয়ে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কাজে ভূমিকা রাখতে পারেন।
সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত নারী সদস্যদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, তারা সংসদের সদস্য হিসেবে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেন না। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট, তাদের এ দাবির পেছনে কোন যৌক্তিকতা নেই। তবে নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা না থাকায় তারা যা করতে পারেন না তা হল, স্থানীয় উন্নয়নে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারেন না। কারণ উপজেলা আইনে শুধু একক আঞ্চলিক এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা এবং পরিষদের ওপর তাদের কর্তৃত্ব বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যদেরও স্থানীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া আমরা শুনেছি, সরকারি দলের নারী সংসদ সদস্যদের বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের আসনে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, সংসদ সদস্যদের স্থানীয় উন্নয়ন কাজে জড়িত হওয়া অন্যায়, অনৈতিক ও সংবিধান পরিপন্থী।
আরেকটি কারণেও সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরা হীনমন্যতায় ভোগেন। তারা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নন। তাদের সংসদ সদস্যপদ প্রাপ্তি বহুলাংশে নির্ভর করে দলীয় হাইকমান্ডের মর্জির ওপর। বস্তুত সংরক্ষিত আসনের সদস্যপদ যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিচার না করে মূলত দলীয় কর্তাব্যক্তিদের পক্ষ থেকে ফায়দা হিসেবে বিতরণ করা হয়। তাই বর্তমান নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের পদ অনেকটা আলঙ্কারিক। যদিও সংসদীয় কার্যক্রমে পরিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তা তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না।
নারীরা আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেক। রাষ্ট্রে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র কায়েম করতে হলে সংসদে নারীদের ন্যায্য ও অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আবশ্যক। তাই সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করা দরকার। একই সঙ্গে সংরক্ষিত আসনে নারীদের নির্বাচন পদ্ধতিও পরিবর্তন করা দরকার। এ লক্ষ্যে রোটেশন বা ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।
রোটেশন পদ্ধতিকে কার্যকর করার জন্য সংসদীয় আসনগুলোকে ভাগ করা প্রয়োজন হবে। উদাহরণস্বরূপ, এক-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যপদ নারীদের জন্য সংরক্ষণ এবং তা কার্যকর করার জন্য ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি ব্যবহার করা হলে আমাদের ৩০০ সংসদীয় আসনকে তিন ভাগে ভাগ করতে হবে। এক্ষেত্রে লটারি পদ্ধতির ব্যবহার করা যেতে পারে। লটারির মাধ্যমে ১০০ আসন চিহ্নিত করে এ আসনগুলোকে প্রথম দফায় নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা যেতে পারে। অর্থাৎ এ আসনগুলোতে কেবল নারীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, অন্য ২০০ আসনে নারী-পুরুষ উভয়েরই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ থাকবে। ২য় দফায়, অর্থাৎ পরের নির্বাচনে অবশিষ্ট ২০০ আসন থেকে লটারির মাধ্যমে ১০০ আসন চিহ্নিত করে সেগুলো নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা যেতে পারে। তৃতীয় দফায় অবশিষ্ট ১০০ আসনে শুধু নারীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, অর্থাৎ এগুলো নারীদের জন্য সংরক্ষিত হবে।
এ পদ্ধতির অনেক আকর্ষণীয় দিক রয়েছে। প্রথমত, সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত নারীদের নিজস্ব নির্বাচনী এলাকা থাকবে এবং এসব নির্বাচনী এলাকা যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে তারা পরবর্তী সময়ে পুরুষদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন। দ্বিতীয়ত, এ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যপদ আর ‘ফায়দা’ হিসেবে ব্যবহূত হবে না। নারীদের নিজস্ব যোগ্যতা ও দক্ষতাই হবে নির্বাচিত হওয়ার মূল মাপকাঠি। তৃতীয়ত, ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব সংসদ সদস্য একই দায়-দায়িত্ব ও ক্ষমতা ভোগ করবেন। ফলে নারী সদস্যদের আর হীনমন্যতায় ভুগতে হবে না। চতুর্থত, বর্তমান সংরক্ষণ পদ্ধতিতে নারীদের ভোটারদের কাছে কোনরকম দায়বদ্ধতা থাকে না, বরং তারা দায়বদ্ধ থাকেন নেতানেত্রীদের কাছে। কারণ নেতানেত্রীদের অনুকম্পার ফলেই তারা নির্বাচিত হন। আর দায়বদ্ধতাহীন ক্ষমতা গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পঞ্চমত, ৩টি নির্বাচনী চক্রে বা তিন দফায় প্রত্যেক আসন থেকে অন্তত একবার একজন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন। এতে দেশে একঝাঁক নারী নেতৃত্ব সৃষ্টি হওয়ার দ্বার উন্মোচিত হবে। ষষ্ঠত, ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি ব্যবহার করলে সংসদে নারী আসনের সংখ্যা বাস্তবে এক-তৃতীয়াংশের বেশি হবে। কারণ সংরক্ষিত আসনের বাইরে থেকেও নারীরা নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ পাবেন।
উল্লেখ্য, ভারতের পঞ্চায়েত বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ ধরনের ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি বহুদিন থেকেই চালু আছে, যার অভিজ্ঞতাও ইতিবাচক। ফলে ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভায়ও নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একই ধরনের ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি প্রয়োগে সম্প্রতি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভারতীয় রাজ্যসভায় ইতিমধ্যেই এ ধরনের একটি আইন পাস হয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংসদে নারী আসন সংখ্যা ১০০-তে উন্নীত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব অর্থবহ করার লক্ষ্যে আমরা আশা করি তারা ভারতের আদলে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি চালু করার উদ্যোগ নেবে। যতদিন পর্যন্ত নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত না হবে, ততদিন এ পদ্ধতি চালু থাকতে পারে। বর্তমান মহাজোট সরকার সংসদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সংবিধান সংশোধন করে উল্লিখিত নিয়ম সহজেই চালু করতে পারে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৬ মে ২০১০
জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন প্রসঙ্গে
Categories: