সম জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের ওপর গুরুত্বারোপ করে যথাযথভাবে সীমানা পুনঃনির্ধারণের দাবী জানিয়েছে নাগরিক সংগঠন সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক। এর অন্যথা হলে অর্থাৎ ভোটার সংখ্যার দিক থেকে বড় আসনগুলোর জনগণ বঞ্চিত হবে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বাধাগ্রস্থ হবে। আজ সকাল ১১টায়, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সুজন নেতৃবৃন্দ এসব কথা বলেন। সুজন সভাপতি জনাব এম হাফিজউদ্দিন খানের সভাপতিতেত্বে ‘নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ নিয়ে কিছু প্রশ্ন’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজমুদার। এছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে উপসি’ত ছিলেন সুজন নির্বাহী সদস্য ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার এবং সুজন এর কোষাধ্যক্ষ জনাব আব্দুল হক প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে সাভারে ভবন ধ্বসে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। এরপর লিখিত বক্তব্য উপস’াপন করতে গিয়ে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন- ‘নির্বাচন কমিশন গত ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণের খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে। এ তালিকার ব্যাপারে আপত্তিগুলোর শুনানি শুরু হয়েছে ২৩ এপ্রিল এবং শুনানি শেষ হবে ১২ মে।’ এ সময় তিনি খসড়া তালিকা নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘খসড়া তালিকাটি কি বিদ্যমান আইন অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে? এটি কি আন-র্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? এক্ষেত্রে কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে কিনা?’ তিনি বলেন, ‘এসব প্রশ্নের সনে-াষজনক উত্তরের ওপর নির্ভর করবে পুনঃনির্ধারিত সীমানার গ্রহণযোগ্যতা এবং কমিশনের নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা।’
সুজন সম্পাদক বলেন ‘খসড়া তালিকা অনুযায়ী, কমিশন ৮৮টি আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ করেছে। তালিকাটি প্রকাশের পর ৮১৩টি আপত্তি নির্বাচন কমিশনে জমা পড়েছে। শুধু ঢাকার বিভিন্ন আসন সম্পর্কে কমিশনে আপত্তি এসেছে ১৮৯টি। আপত্তি উত্থাপনকারীদের পক্ষ থেকে সর্বমোট ৮৮টি পরিবর্তিত সংসদীয় আসনের ৫৫টির বিদ্যমান সীমানা বহাল রাখার দাবি এসেছে। বাকি ৩৩টি আসনের ৩১টির বিভিন্ন এলাকা সংযোজন ও বিয়োজনের প্রস-াব করা হয়েছে। অন্য দুটিতে ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী সীমানায় ফিরে যাবার দাবি এসেছে।’
বক্তব্যে বলা হয়, ‘কমিশন কর্তৃক জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বর্ণিত পদ্ধতি আইনে নির্ধারিত মানদণ্ডের সঙ্গে পুরোপুরিভাবে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বস’ত, বর্তমান কমিশনের সামপ্রতিক পদক্ষেপ আইনের উদ্দেশ্যের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক। কারণ সীমানা পুনঃনির্ধারণের পর আসনগুলোর মধ্যে ভোটার সংখ্যার পার্থক্য হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে আরও বেড়েছে। নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে, ‘নির্বাচনী এলাকাসমূহের পূর্বে নির্ধারিত সীমানা যতদূর সম্ভব বহাল রাখা’ হয়েছে। কিন’ সীমানা পুনঃনির্ধারণের উদ্দেশ্যই হল জনসংখ্যার তথ্য বিবেচনায় নেওয়া, যাতে করে জনসংখ্যার দিক থেকে নির্বাচনী এলাকাসমূহে যতদূর সম্ভব সমতা সৃষ্টি হয়। এ কারণেই প্রতিটি আদমশুমারীর পর নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ করা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই কমিশনের পূর্বে নির্ধারিত সীমানা যতদূর সম্ভব বহাল রাখার নীতিগত সিদ্ধান- কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বস’ত, এই নীতি অনুসরণের ফলে কমিশনের নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ সংক্রান- সামপ্রতিক পদক্ষেপ, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, লোক দেখানো উদ্যোগ বলেই মনে হতে পারে।
সুজন সম্পাদক বলেন, বর্তমান কমিশনের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে সীমানা পুনঃনির্ধারণ না করার কারণে অতীতের ন্যায় নির্বাচনী এলাকাসমূহের মধ্যে ভোটার সংখ্যার বিরাট পার্থক্য দেখা দিয়েছে। যেমন, গত নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের সীমানা পুনঃনির্ধারণের পর সবচেয়ে বড় নির্বাচনী এলাকার (ঢাকা-১৯) ভোটার সংখ্যা ছিল ছয় লাখ ২ হাজার ৩৮৬ জন; একই সময়ে সব চেয়ে ছোট নির্বাচনী এলাকার (ঝালকাঠি-১ আসনে) ভোটার সংখ্যা ছিল এক লাখ ৩৭ হাজার ৯১ জন। অর্থাৎ এই দুই নির্বাচনী এলাকার ভোটার সংখ্যার পার্থক্য ছিল সাড়ে চার লাখের বেশি।’ এই অসমতা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনে ১০৬টি আসনের ভোটার সংখ্যা হবে আসন প্রতি গড় ভোটার সংখ্যার +-১০ শতাংশের মধ্যে, ৯২টি (৪১+৫১) আসনের +-২০ শতাংশের মধ্যে এবং বাকি ১০২টি (১৬+২৬+৩১+২৯) আসনের +-২১ শতাংশের বেশি। তাই দেখা যাচ্ছে যে, যেখানে ২০০৮ সালে আসন প্রতি গড় ভোটার সংখ্যা থেকে +- ২১ শতাংশের বেশি ভোটার সম্বলিত আসন সংখ্যা ছিল ৮৩, সেখানে ২০১৩ সালের ভোটার তালিকা অনুযায়ী তা এসে দাঁড়িয়েছে ১০২-এ। অর্থাৎ ২০১৩ সালের সীমানা পুঃনির্ধারণের ফলে সংসদীয় আসনগুলোর মধ্যে ভোটার সংখ্যার দিক থেকে ২০০৮ সালের তূলনায় আরও অসমতা বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘এটি সুষ্পষ্ট যে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জারি করা বিজ্ঞপ্তি থেকে দেখা যায় যে, ২০০৮ সালের নির্ধারিত সীমানার যে ৮৮টিতে পরিবর্তন এনেছে, তা নিঃসন্দেহে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার ভোটার সংখ্যায় সমতা আনার জন্য করা হয়নি। তবে কি শুধুমাত্র প্রশাসনিক সুবিধা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য তা করা হয়েছে? না কি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেছে? সরকারি দলের একাধিক সংসদ সদস্যই নির্বাচনের কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের অভিযোগ তুলেছেন।’
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এটি সুসপষ্ট যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেন বিতর্ক এড়াতে পারছে না। বিতর্ক রয়েছে কমিশনের সদস্যগণের নিয়োগ এবং তাঁদের ব্যাকগ্রাউণ্ড নিয়ে। তাঁদের কিছু বক্তব্য ও আচরণ নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে। এখন প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে কমিশনের নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণের যথার্থতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে। আমরা জানি না এ বিতর্কের শেষ কোথায়!’ বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচার ও আলোচনা হওয়া দরকার এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা ও উদ্যোগ নেয়ার দরকার বলে মনে করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে জনাব এম হাফিজউদ্দিন খান কমিশনের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠনের দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘সীমানা নির্ধারণ আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী, কমিশনের সীমানা নির্ধারণ সংক্রান- কার্যক্রম ও সিদ্ধান- আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এছাড়াও কমিশনের সিদ্ধান- চ্যালেঞ্জ করার জন্য অন্য কোনো আপিল অথরিটিও নেই। তাই কোনোরূপ স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা পক্ষপাতদুষ্ট কাজ করলে কমিশনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কোনো পদ্ধতি নেই। কোনো বিধান নেই কমিশনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার।’ তাই প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করে সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠনের বিষয়টি আজ গভীরভাবে বিবেচনা করা আবশ্যক বলে মনে করেন তিনি।
মূল প্রবন্ধ ও আসনভিত্তিক ভোটার সংখ্যার তুলনামূলক বিশ্লেষণ ২০০৮ ও ২০১৩