সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক গোলটেবিল বৈঠক ‘নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

‘নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

????????????????????????????????????

রাজনৈতিক বিতণ্ডা এড়ানোর লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে সকল রাজনৈতিক দলকে সম্পৃক্ত করা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক নেতৃবৃন্দ। তাঁরা সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়নেরও দাবি জানান। আজ ১৫ অক্টোবর ২০১৬, সকাল ১০.০০টায়, জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকে সুজন নেতৃবৃন্দ এ দাবি জানান।

সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার জনাব এ. টি. এম শামসুল হুদা ও বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. শাখাওয়াত হোসেন, অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুজন নির্বাহী সদস্য ড. হামিদা হোসেন, ড. শাহদীন মালিক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, জনাব আলী ইমাম মজুমদার, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, রাজনীতিবিদ জনাব শেখ শহিদুল ইসলাম, জনাব এ এস এম আকরাম, হুমায়ূন কবীর হিরু এবং সুব্রত চৌধুরী প্রমুখ।

আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তথা জেনুইন ইলেকশান পরিচালনার জন্য একটি সঠিক প্রতিষ্ঠান আবশ্যক। এ লক্ষ্যে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে ‘আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে’ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্বাচন কমিশনে কমিশনার নিয়োগ দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। কমিশনে নিয়োগ দেয়ার জন্য একটি আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা থাকলেও গত ৪৪ বছরেও মানা হয়নি। তাই সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী আইন প্রণয়ন না করে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদান করা না হলে, সেই নিয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য হলো মূলত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার মানদণ্ড ও কর্মের শর্তাবলী নির্ধারিত করে দেওয়া, যাতে জেনুইন বা সঠিক নির্বাচনের জন্য সঠিক ব্যক্তিদেরকে নিয়ে কমিশন গঠিত হয়। অতীতে সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করে সঠিক ব্যক্তিদেরকে কমিশনের নিয়োগ না দেওয়ার কারণে সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীন হলেও অনেক ক্ষেত্রেই কমিশনের সদস্যরা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ নিয়ে আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক বিরোধ বিরাজমান। অতীতের প্রায় সকল নিয়োগ নিয়েই, বিশেষত দলীয় সরকারের অধীনে নিয়োগ নিয়ে পক্ষপাত দুষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। তাই রাজনৈতিক বিতণ্ডা এড়ানোর লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলকে সম্পৃক্ত করা দরকার। আমাদের প্রস্তাব হবে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের নির্দেশনা অনুসরণ করে প্রথমেই একটি আইন প্রণয়ন করা।’ এক্ষেত্রে ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত গত নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রণীত নিয়োগ সংক্রান্ত আইনের একটি খসড়া কাজে লাগানো যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

প্রবন্ধের শেষভাগে ড. মজুমদার বলেন, ‘ভবিষ্যতে রাজনৈতিক বাক-বিতণ্ডা এড়ানোর লক্ষ্যে আমরা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদেরকে কমিটির সদস্য করার প্রস্তাব করছি। একইসঙ্গে অনুসন্ধান কমিটির নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে আমরা এতে নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদেরকে সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব করছি। অনুসন্ধান কমিটিকে অবশ্যই স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। স্বচ্ছতার খাতিরে কমিটি নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দানের জন্য জনগণের কাছে নাম সুপরিশ করার আহ্বান করতে পারে। এভাবে যাঁদের নাম সুপারিশ করা হয় তাঁদের সম্মতির ভিত্তিতে আইনে বর্ণিত যোগ্যতা-অযোগ্যতার মানদণ্ডের আলোকে অনুসন্ধান কমিটি নিয়োগের যোগ্য সম্ভাব্য ব্যক্তিদের নামের একটি শর্টলিস্ট তৈরি করে গণশুনানির আয়োজন করতে পারে। গণশুনানির পর অনুসন্ধান কমিটি প্রত্যেক শূন্য পদের বিপরীতে দুইজন করে চিহ্নিত করে সর্বোচ্চ দশজনের নামের একটি প্যানেল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করবে। দশজনের নামের প্যানেল থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ পাঁচজনের নাম সুপারিশ করবেন, যার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ প্রদান করবেন। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্তত একজন নারী যেন নিয়োগ প্রাপ্ত হন।’

এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘অতীতে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বর্তমানে দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে কাজ করছে না। মূলত সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের সদিচ্ছা।’ তিনি সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানান।

এ. টি. এম শামসুল হুদা বলেন, ‘আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থার অভাব রয়েছে। যে কারণে যারা হেরে যান তারা কারচুপির অভিযোগ আনেন। তাই নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার অভাব নিরসন করতে হবে এবং নির্বাচনী ফলাফল মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, ‘অনেক দেশেই রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে পরে কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে কারো আপত্তি থাকে না।’ যাদের বিরুদ্ধে দলপ্রীতির অভিযোগ নেই এবং যাদের সুনাম রয়েছে তারাই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) এম. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচন কমিশন হলো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মূল কেন্দ্র। তাছাড়া কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সাধারণত কর্তৃত্ববাদী সরকার গঠিত হয়।’ তিনি বলেন, ‘সকলের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।’ তবে আইনের মাধ্যমেই নির্বাচন কমিশন গঠন হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন অপরিহার্য। তবে নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে কথা বলা দরকার।’ মূলত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চাইলেই দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ কীভাবে নিশ্চিত হতে পারে এ নিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সকল দলের অংশগ্রহণে আলোচনার সূত্রপাত করতে পারেন।’ নির্বাচনী পরিবেশ ঠিক হয়ে গেলে নির্বাচনী ম্যাকানিজম নিয়ে পরে আলোচনা করা যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চেতনা হলো গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো নির্বাচন। তাই আমরা একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নির্বাচন।’

ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘আইন প্রণয়ন করা ছাড়া নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। তাই এ অবস্থায় ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যাঁরা শপথ গ্রহণ করবেন তাদেরকে আইনি ঝামেলা পোহাতে হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘সার্চ কমিটিতে বিচারপতিদের না রাখাই ভাল। কারণ তাদের কোনো প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থাকে না।’

সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থাহীনতা রয়েছে। জনগণের মধ্যে আশঙ্কা রয়েছে সরকার যোগ্য ব্যক্তিদের কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেবে কিনা। এক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগী হয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন।’ সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি ও রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দানে পরামর্শ দিতে পারেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

গোলটেবিল বৈঠকে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় সকল রাজনৈতিক পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদের যুক্ত করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন ড. হামিদা হোসেন।

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমরা একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন চাই। কিন্তু শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এজন্য দরকার সরকারের সদিচ্ছা।’ তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলেও সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে গঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মূল প্রবন্ধ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

 

Related Post

‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ও সংসদের মেয়াদ’ শীর্ষক সুজনে’র গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ও সংসদের মেয়াদ’ শীর্ষক সুজনে’র গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত

গত ৭ জানুয়ারি, ২০১০ সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর উদ্যোগে ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ও সংসদের মেয়াদ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ‘সুজন’

সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর উদ্যোগে ‘রোহিঙ্গা সমস্যা: বর্তমান পরিস্থিতি ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিতসুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর উদ্যোগে ‘রোহিঙ্গা সমস্যা: বর্তমান পরিস্থিতি ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের জন্য জাতীয় ঐক্য আজ একান্ত জরুরি_ এমনি মন্তব্য করেছেন ‘সুজন_সুশাসনের জন্য নাগরিক’ নেতৃবৃন্দ। আজ ১২ অক্টোবর ২০১৭, সকাল ১০.০০টায়, জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সুজন আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা সমস্যা:

সুজন-এর উদ্যোগে ‘নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনসুজন-এর উদ্যোগে ‘নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

‘নতুন নির্বাচন কমিশনকে জনগণের মধ্যে আস্থা অর্জন করা এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে মতানৈক্যে পৌঁছা এবং স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিতে হবে’ বলে মন্তব্য