সংলাপ, সমঝোতা, না সংঘাত?


বদিউল আলম মজুমদার
আমরা আনন্দিত যে, অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপ শুরু হয়েছে। তবে সংলাপ সম্পর্কে অতীত অভিজ্ঞতা ইতিবাচক নয়, ফলাফলও সুখকর নয়। কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টিফেনের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত সংলাপের অসফলতা আমাদের ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-এর প্রহসনের নির্বাচন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার মতো পন্থা উপহার দিয়েছিল, যা আমাদের রাজনীতিতে দায়িত্বহীনতার সমস্যাকে আরও প্রকট করেছে। ২০০৬ সালে আব্দুল জলিল-মান্নান ভূঁইয়া সংলাপ বস্তুত আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে খাদে ফেলে দিয়েছে। দেশে জরুরি অবস্থা ডেকে এনেছে। এবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ ব্যর্থ হলে আরও বড় সংকট সৃষ্টি হতে পারে। তাই এ সংলাপ সফল করতেই হবে। জাতির সামনে আজ অনেকগুলো দুরূহ সমস্যা, এগুলো সমাধানের জন্য যে জনকল্যাণমুখী রাজনীতি প্রয়োজন, তা অনুপস্থিত। বস্তুত আমাদের রাজনীতি আজ চরমভাবে রোগগ্রস্ত, যার চিকিৎসা না হলে জাতিকে চরম মাশুল গুনতে হতে পারে। রোগের সফল চিকিৎসার জন্য প্রথমে যথাযথ রোগ নির্ণয় প্রয়োজন, তারপর প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থাপত্র। তবে শুধু উপসর্গের চিকিৎসা করলে রোগ নিরাময় হবে না।
স্মরণ করা প্রয়োজন যে, স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে ঘোষিত তিন জোটের যুক্ত ঘোষণায় ১০টি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাঁচটি ছিল তাদের দাবি−সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সৃষ্টি ও নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন; বাকিগুলো ছিল নির্বাচিত সরকারের করণীয় সম্পর্কে অঙ্গীকার। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সার্বভৌম জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করা, সংসদের কাছে প্রশাসনের জবাবদিহি নিশ্চিত করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা, মৌলিক অধিকার পরিপন্থী সব আইন বাতিল করা, অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের সব প্রচেষ্টা প্রতিহত করা এবং নির্বাচন ব্যতীত অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায় বা অন্য কোনো অজুহাতে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত না করা ছিল তিনদলীয় জোটের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার।
১৯৯১ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা বদলের পর নির্বাচন নিতান্তই জনগণের সম্মতিতে ক্ষমতা বদলের পদ্ধতি−একটি সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষা ছিল যে, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করবে, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের পরিবর্তে জনকল্যাণে নিবেদিত হবে এবং তিনদলীয় জোটের যুক্ত ঘোষণা বাস্তবায়ন করবে। আরও আকাঙ্ক্ষা ছিল, সরকার ও বিরোধী দল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা করবে, রাজপথের পরিবর্তে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংসদে বসে সমস্যার সমাধান করবে, ফলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
সুশাসন মানে আইনের শাসন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, সমতা, ন্যায়পরায়ণতা ও জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা। সুশাসন অর্জিত হওয়ার অর্থ বিকেন্দ্রীকরণ ও প্রশাসনের সব স্তরে নাগরিকের কার্যকর অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তি। এ ছাড়া সুশাসনের মাধ্যমে ‘ভোটের’ অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ‘ভাতের’ অধিকার তথা রাষ্ট্রীয় সম্পদে তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হবে, তাও কাম্য ছিল।
অনেকের আশা ছিল যে পরপর কয়েকটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পর দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে। গণতন্ত্রকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগসহ কতগুলো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করার এবং ‘আংশিকের’ পরিবর্তে ‘পূর্ণ’ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আমাদের ‘প্রতিনিধিত্বশীল’ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ‘অংশগ্রহণমূলক’ গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হবে। আরও আশা ছিল যে, সরকারি ও বিরোধী দল সর্বক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের চর্চা করবে।
দুর্ভাগ্যবশত, ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর সংসদীয় পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন ছাড়া তিন জোটের যুক্ত ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কোনো সরকারই তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত রেষারেষি, ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিরোধী দলের অসহযোগিতার কারণে নির্বাচিত সংসদও অকার্যকর হয়ে পড়ে। আবেগের দ্বারা তাড়িত হয়ে নবনির্বাচিত সরকার উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যকার অসহযোগিতার সম্পর্ক প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে রূপ নেয় মাগুরার উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের কারচুপি এবং তা প্রতিহত করতে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার পর। এমনই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলের নিজেদের সংস্কার এবং নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার দাবি না তুলে সব বিরোধী দল মিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তোলে, যা ক্ষমতাসীনেরা অনমনীয়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তী সময়ে, স্যার নিনিয়ানের মধ্যস্থতায় সংলাপের ব্যর্থতার পর অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন। সে নির্বাচন আবার বাতিল হয় রাজপথের আন্দোলনের কারণে। অনেকের ধারণা, উপজেলা পদ্ধতি বহাল থাকলে এবং রাজনৈতিক দলগুলো দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সৃষ্ট সমস্যার সঠিক ডায়াগনসিস করে সে সময় রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ভিন্ন হতো।
রাজপথের আন্দোলন এবং তা প্রতিহত করার জন্য একদল কর্মিবাহিনী ও তাদের বাহুবলসম্পন্ন সহযোগীদের পোষা প্রয়োজন। আন্দোলনের সফলতার জন্য আরও প্রয়োজন হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি। এভাবে রাজনীতিতে অঙ্গসংগঠন ও পেশিশক্তির এবং বিশৃঙ্খল আচরণের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। কর্মিবাহিনী লালন-পালনের জন্য প্রবর্তিত হয় ফায়দাবাজির−অন্যায়ভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা দলীয় অনুগতদের মধ্যে বিতরণ। এর জন্য আরও প্রয়োজন হয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা সংগ্রহ। ফায়দা প্রদান করে পেশাজীবীদেরও বিভক্ত করে ফেলা হয়। নব্বইয়ে গণতন্ত্রের লড়াকু সৈনিকদের অনেকে এ দলবাজি ও ফায়দাবাজির জালে আটকাও পড়েন এবং পরবর্তী সময়ে লুটেরায় পরিণত হন। এ বিভক্তিতে অবশ্য কিছু প্রতীক ও ‘আদর্শের’ স্লোগান ব্যবহৃত হয়। এমনকি উচ্চ আদালত ও সরকারি কর্মকর্তারাও দলবাজি ও ফায়দাবাজির কবলে পড়েন। প্রশাসনে ও বিচার বিভাগে দলবাজির কারণে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা বঞ্চিত হতে থাকেন এবং অসৎ ও অযোগ্য ব্যক্তিরা পুরস্কৃত হতে থাকেন। এ কারণেই সর্বত্র আজ অযোগ্যতা, বিশৃঙ্খলা আর মেধাশূন্যতা দৃশ্যমান। এ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলো হয়ে পড়ে নীতি-আদর্শবিবর্জিত মূলত ফায়দাবাজদের সিন্ডিকেট। রাজনীতি হয়ে পড়ে সুনির্দিষ্ট নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাব্রতী প্রচেষ্টার পরিবর্তে হীন ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার মোক্ষম হাতিয়ার। যেহেতু দলবাজি দলীয় সমর্থকদের পুরস্কৃত করে এবং দলনিরপেক্ষদের তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, ফলে আমাদের সমাজে ক্রমাগতভাবে নির্দলীয় মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে এবং সমাজ ক্রমান্বয়ে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। এ প্রক্রিয়ায় নব্বইয়ের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে একতাবদ্ধ জাতি চরমভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বস্তুত রাজনীতি যে নিয়মতান্ত্রিক ও সংসদকেন্দ্রিক হতে পারে, সে ধারণাই আজ অনেক নেতা-নেত্রীর মধ্যে নেই।
নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের অভাবে গত দেড় দশকের নির্বাচিত সরকারের আমলে ক্ষমতা ও সম্পদ ক্রমাগতভাবে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা দুর্নীতির জন্ম দেয় এবং তা স্থায়ী করতে সহায়তা করে। কিছু ব্যক্তির হাতে সরকারি ও দলীয় ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ আমাদের দেশে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নকে সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী করতে সহায়তা করেছে। সংসদ সদস্যদের অনেকেই ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীয়করণের ‘উপকার’ ভোগ করেন এবং দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন।
১৯৯১ সালের পর আরও দুটি মোটামুটিভাবে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও দেশে কার্যত নির্বাচনসর্বস্ব এবং জবাবদিহি ও স্বচ্ছতাবিবর্জিত ‘এক দিনের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে নির্বাচনের পর নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পরিণত হন সামন্ততান্ত্রিক প্রভুতে এবং জনগণ বিবেচিত হতে থাকে ‘ভেড়ার পালে’। এক দিনের গণতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিই ইজারাতন্ত্র−লুটপাট করার ইজারা প্রতিষ্ঠা। এ ইজারা বংশপরম্পরায় টিকিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টি হয় পরিবার বা আত্মীয়তন্ত্রের। ফায়দাবাজির মাধ্যমে অবশ্য লুটপাটের ইজারা উচ্ছিষ্ট অংশ শেয়ার করা হয় ‘নেতা-কর্মীদের’ মধ্যে। অনেকের মতে, তিন জোটের যুক্ত ঘোষণা অনুযায়ী, একটি কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠিত হলে সম্ভবত এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানো যেত।
লুটপাটতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন একদল ব্যক্তিকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত করে এনে একটি তাঁবেদার সংসদ গঠন করা। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব ও তাঁবেদার সংসদ গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিরাজমান হাতিয়ার, কারণ অনুচ্ছেদটি প্রধানমন্ত্রীকে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ না করে দলীয় সাংসদদেরই প্রধানমন্ত্রীর আজ্ঞাবহ করে তোলে। এমন তাঁবেদার সংসদ গঠনের জন্যই কালো টাকা ও পেশিশক্তির মালিকদের কাছে মনোনয়ন বিক্রি করে আমাদের রাজনীতিতে ‘বিরাজনীতিকরণ’ প্রক্রিয়ার সূচনা করা হয়। ফলে আমাদের সংসদ হয়ে পড়ে বহুলাংশে ব্যবসায়ীদের প্রাইভেট ক্লাবে। এভাবে আমাদের দেশে, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ভাষায়, ‘সামন্ততান্ত্রিক গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছে।
পরিবারতন্ত্রের ছত্রচ্ছায়ায় সামন্ততান্ত্রিক পন্থার এ লুটপাটতন্ত্রের ইজারা টিকিয়ে রাখার পথে একটিই মাত্র বাধা বিদ্যমান, তা হলো নির্বাচন নামের একটি আনুষ্ঠানিকতা। লুটপাটতন্ত্রকে বৈধতা দিতে অবশ্য নির্বাচনের প্রয়োজন হয়। তবে লুটপাটের ইজারা যাতে কোনোভাবেই হাতছাড়া না হয় সে জন্য কারসাজির মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল পূর্বনির্ধারিত করা জরুরি হয়ে পড়ে। এমন কারসাজি নগ্নরূপ ধারণ করে গত জোট সরকারের আমলে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের সময়সীমা বৃদ্ধি, সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রপতির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ, বিচারপতি এম এ আজিজের মতো ব্যক্তিদের বেআইনিভাবে নির্বাচনে কমিশনে মনোনয়ন, কমিশনের মাঠপর্যায়ে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ, প্রশাসনের সব স্তরে দলীয় সমর্থকদের পদায়ন ইত্যাদি ছিল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রভাবিত করার একটি নীল নকশার অংশ। এসব কারসাজি এমন অযৌক্তিক পর্যায়ে পৌঁছায় যে পুরো প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া খাদে পড়ে যায়, জরুরি অবস্থা জারি হয় এবং ২২ জানুয়ারি ২০০৭-এর একতরফা সম্ভাব্য নির্বাচন বাতিল করা হয়। তাই ১১ জানুয়ারি ২০০৭ তারিখের ঘটনা একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বলেই আমাদের ধারণা।
ওপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, জাতি আজ দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ক্যান্সারে আক্রান্ত। এর মূল কারণ হলো একের পর এক নির্বাচিত সরকারগুলোর ক্ষমতার অপব্যবহার; অসৎ ব্যক্তিদের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ; অগণতান্ত্রিক, অস্বচ্ছ ও দায়বদ্ধতাহীন রাজনৈতিক দল; দুর্বল ও আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন; অকার্যকর সংসদ; রাজনীনিতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চার অভাব ইত্যাদি। আর এ ব্যাধির উপসর্গ হলো রাজনীতিতে দলবাজি, ফায়দাবাজি, চাঁদাবাজি ও সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ; ২২ জানুয়ারি ২০০৭ তারিখে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন বাতিল ইত্যাদি। জাতির এ ব্যাধি দুরারোগ্য হলেও নিরাময়যোগ্য, যদিও এর জন্য রেডিক্যাল সার্জারি আবশ্যক। চৌদ্দ দলের ১৫ জুলাই ২০০৫ এবং ২২ নভেম্বর ২০০৫ তারিখের ঘোষণা ও ‘অভিন্ন কর্মসূচি’তে এসব সমস্যার স্বীকৃতি এবং এগুলো নিরাময়ের ব্যবস্থাপত্রও দেওয়া হয়। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও সংস্কারের সুস্পষ্ট প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।
সংলাপে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের চিকিৎসার পথ বের করা হবে অত্যন্ত জরুরি। এ চিকিৎসার জন্য অবশ্য সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ও কালো টাকার মালিক তথা দুর্বৃত্তদের স্বচ্ছ ও দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিরত রাখতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিজেদের সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে হবে, অর্থাৎ চিহ্নিত ব্যাধির ওষুধ সেবন করতে হবে। একই সঙ্গে রোডম্যাপ অনুযায়ী সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে এটি যেন নীল নকশার নির্বাচন না হয়। এ জন্য সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকেও সদাচরণের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে। নির্বাচন-পরবর্তীকালে একটি কার্যকর সংসদের মাধ্যমে সরকারের যাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হয় এবং ক্ষমতাসীনেরা দলবাজি, ফায়দাবাজি, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকেন, তাও নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি রোধ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদিও সংলাপের বিষয়বস্তু হওয়া উচিত। এসব সমস্যা সমাধানের সুস্পষ্ট পদক্ষেপ সম্পর্কে ঐকমত্যে পৌঁছাই হবে সংলাপের লক্ষ্য। তবে ঐকমত্যে পৌঁছালেই হবে না, সংশ্লিষ্ট সবাইকে তাঁদের কথা রাখতে হবে। অতীতে এ সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত তিক্ত এবং তার মাশুল আজ আমরা দিচ্ছি। তাই সংলাপের সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন নিরীক্ষণের একটি পদ্ধতি বের করতে হবে। ইতিহাসে এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন ম্যাগনাকার্টা দলিল স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এর বাস্তবায়ন নিরীক্ষণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। তেমনিভাবে সংলাপের মাধ্যমে অর্জিত ঐকমত্যগুলো নজরদারির জন্য কয়েকজন সর্বাধিক সম্মানিত নাগরিককে নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যাদের কাজ হবে এগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে দেশবাসীকে নিয়মিতভাবে অবগত রাখা।
পরিশেষে, সংলাপে ব্যর্থতার কোনো অবকাশ নেই। সংলাপ ব্যর্থ হলে রাজপথ হবে সমস্যা সমাধানের স্থান এবং সংঘাত হবে এর মাধ্যম। আর যুক্তি ও আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে মীমাংসার পরিবর্তে এ সমাধান হবে ‘জোর যার মুল্লুক তার’-এর সমাধান, যা স্থায়ী সমাধান নয়। তবে এর মাধ্যমে আইনের শাসন ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া সমুন্নত হওয়ার পরিবর্তে তা পদদলিত হবে এবং যথেচ্ছাচার বা এনার্কির জন্ম দেবে। সেটা কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সংলাপে ব্যর্থতা এবং এর পরিণতিতে সৃষ্ট সহিংসতা উগ্রবাদের বিস্তারকেই ত্বরান্বিত করবে এবং জাতি এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, ২৫ এপ্রিল ২০০৮

Related Post

দুর্নীতি দমন: কার স্বার্থে দুদককে অকার্যকর করা হচ্ছেদুর্নীতি দমন: কার স্বার্থে দুদককে অকার্যকর করা হচ্ছে

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ০৩-০৫-২০১০ গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মন্ত্রিসভা সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সংশোধিত আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে। অনুমোদিত খসড়াটি মূলত মন্ত্রিপরিষদের অধীনে শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত

বিশেষ অধিকার ও গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতাবিশেষ অধিকার ও গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা

সংসদ বদিউল আলম মজুমদার কয়েক সপ্তাহ আগে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দু’জন বিচারকের বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণ এবং পরে তা প্রত্যাহারের বিষয়ে তদন্ত করার লক্ষ্যে

বুয়েট: বিব্রত হওয়া শিক্ষামন্ত্রীর কাজ নয়বুয়েট: বিব্রত হওয়া শিক্ষামন্ত্রীর কাজ নয়

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ২৭-০৭-২০১২ নুরুল ইসলাম নাহিদ মহাজোট মন্ত্রিসভার এক সৎ, যোগ্য এবং জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তি। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নসহ তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন এবং