সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক ড. বদিউল আলম মজুমদার,লেখালেখি সরকার ও বিশ্বব্যাংক: পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির পরিণতি

সরকার ও বিশ্বব্যাংক: পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির পরিণতি

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ১৩-০৭-২০১২

পদ্মা সেতু নিয়ে যা হলো তার পরিণতি অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। পদ্মা সেতু নির্মিত না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতেই, (দি ডেইলি স্টার, ৩ জুলাই ২০১২) সেতুটির কারণে ২০১৫ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী ৩১ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি বা দেশজ উৎপাদন বাড়বে ছয় বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা)। একই সময়ে দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে ৫০ শতাংশ এবং কর্মসংস্থান ১০ দশমিক ২ শতাংশ। বাৎসরিক হারে জাতীয়ভাবে দারিদ্র্য কমবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং দক্ষিণাঞ্চলে ২ শতাংশ। এ ছাড়া নয় হাজার হেক্টর জমি নদীভাঙন থেকে রক্ষা পাবে। জমি রক্ষা, বিদ্যুৎ-গ্যাসলাইন ও ফাইবার অপটিক লাইন স্থাপন এবং ফেরি সার্ভিস বন্ধ থেকে সরকারের সাশ্রয় হবে প্রায় ৮৩০ কোটি টাকা। তাই পদ্মা সেতু নির্মাণ বন্ধ সব বাংলাদেশি, বিশেষত দক্ষিণবঙ্গের মানুষের পেটে লাথি মারারই সমতুল্য হবে।

বিশ্বব্যাংক দাবি করেছে, দুর্নীতির সুস্পষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। আমাদের সরকার অবশ্য বরাবরই দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং কিছু কর্মকর্তা। অভিযোগটি গুরুত্বের সঙ্গে না নিয়ে এবং পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এটির সমাধান না করে, সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিশ্বব্যাংকের কঠোর সমালোচনায় লিপ্ত হন এবং দুর্নীতি প্রমাণ করার জন্য সংস্থাটির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও এতে সুর মিলিয়ে বলেন যে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি প্রমাণ করতে না পারলে সরকার তাদের কাছ থেকে ঋণ নেবে না (যার মানে দাঁড়ায়, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলেই সরকার তাদের কাছ থেকে ঋণ নেবে)। কেউ কেউ বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও উত্থাপন করেন এবং নানামুখী বাগাড়ম্বরে লিপ্ত হন।

একই সঙ্গে মন্ত্রীদের অনেকেই বলতে থাকেন যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ আমাদের প্রয়োজন নেই—পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বহু দেশ আমাদের ঋণ দিতে আগ্রহী। প্রয়োজনে নিজেদের অর্থ দিয়েই আমরা তা করব। এমনকি মালয়েশিয়ার একটি গ্রুপের সঙ্গে আমরা সমঝোতা চুক্তি সম্পাদনেরও উদ্যোগ নিয়েছি, যা বিশ্বব্যাংকের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের সমতুল্য। অর্থাৎ কূটনৈতিকভাবে সমস্যাটি সমাধানের পরিবর্তে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে অনেকটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও জেদাজেদির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছি, যার মাশুল হয়তো পুরো জাতিকেই গুনতে হবে।

নিজস্ব ব্যর্থতার জন্য অজুহাত দাঁড় করানো একটি স্বাভাবিক মানবিক দুর্বলতা। কিন্তু আমাদের জন্য এটি যেন একটি দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তাই বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই বিষয়টি নীরবে সমাধানের পরিবর্তে আমাদের সরকার প্রথাগতভাবেই এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র খুঁজতে থাকে। বিশ্বব্যাংকও এ অভিযোগ থেকে রেহাই পায়নি। এমনকি কেউ কেউ নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের প্রতিও অঙ্গুলি প্রদর্শন করেন। কোনো ব্যক্তির পক্ষে, ব্যক্তি যত গুরুত্বপূর্ণই হোন না কেন; বিশ্বব্যাংকের এত বড় একটি সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে পারেন বলে যাঁরা ধারণা করেন, তাঁরা নিতান্তই বোকার স্বর্গে বাস করেন।

এ কথা সত্য যে, বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তবে তারা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ হালে পানি পায় না। কারণ, গত সরকারের সময়ও প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির অভিযোগে কয়েকটি প্রকল্প বাতিল করেছিল।
আর বিশ্বব্যাংকের উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ সরকার বারবার অস্বীকার করলেও আমাদের আশঙ্কা, দলান্ধরা ছাড়া বাংলাদেশের খুব কম মানুষই এ বিষয়ে সরকারের কথায় আস্থা রাখতে পারছে। উদাহরণ স্বরূপ, ইত্তেফাক-এর (৩ জুলাই ২০১২) অনলাইন জরিপে ‘পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের প্রমাণ নেই—অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্য সমর্থন করেন?’ এ প্রশ্নের ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতাই ‘না’ বলেন। যদিও অনলাইন জরিপ বিজ্ঞানভিত্তিক নয়, তবুও এর ফলাফল থেকে জনমত সম্পর্কে একটি ধারণা অন্তত পাওয়া যায়। অর্থাৎ পদ্মা সেতুর ঠিকাদার নিয়োগে দুর্নীতি হয়নি বলে সরকারের দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

দুর্নীতি দমনের বিষয়ে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবের প্রধান কারণ হলো, এটি বর্তমান সরকারের ‘দিন বদলের সনদ’-এর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি অগ্রাধিকারের দ্বিতীয়টি হলেও এ ব্যাপারে গত সাড়ে তিন বছরে সরকারের কৃতিত্ব প্রায় শূন্যের কোঠায়। এ পর্যন্ত একজন নামকরা দুর্নীতিবাজেরও সাজা হয়নি। সরকারের সঙ্গে জড়িত কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও আনা হয়নি। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যে সামান্য কয়েকজনের শাস্তি হয়েছিল, তাঁরাও আদালত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এমনকি তাঁদের কাউকে কাউকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে পুরস্কৃতও করা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সৈয়দ আবুল হোসেন ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে বাদ দেওয়া হয়নি। এসব কারণে দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক।

আরও দুটি বিষয়, যার একটি হলো তথাকথিত ‘ইউনূস ইস্যু’, বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে বলে আমাদের আশঙ্কা। অনেকেই হয়তো অবগত নন যে, সারা পৃথিবীতে, বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বের সচেতন সমাজে অধ্যাপক ইউনূস ‘রক স্টার’-এর মতোই জনপ্রিয়। তাই তাঁর প্রতি সরকারের অন্যায্য ও আক্রমণাত্মক আচরণ শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্লিনটন পরিবারকেই নয়, সারা বিশ্বের অনেককেই হতবাক করেছে। অনেক সরকার প্রফেসর ইউনূসের প্রতি সদাচরণ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধও করেছে। শোনা যায়, সরকার এ ব্যাপারে তাদের আশ্বস্তও করেছিল। এর পরও সরকার গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তাঁকে পদচ্যুত করায় এবং উচ্চ আদালত এ ব্যাপারে তাঁর মামলা করার অধিকার বা ‘লোকাস্টেন্ডি’ নেই বলে রায় দেওয়ায়, অনেক সরকারই ক্ষুব্ধ হয়েছে। গত কয়েক বছর চেষ্টার পরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ব্যর্থ হওয়া এবং গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সম্প্রতি গঠিত কমিটি এ ক্ষোভের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিয়েছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের অনেকেই চরমভাবে উদ্বিগ্ন। তারা চায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা। আইনের শাসন ও মানবাধিকার সংরক্ষণ। হত্যা-গুম ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়নের অবসান। প্রসঙ্গত, উদীয়মান শক্তি ভারত ও চীন নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ায় বাংলাদেশের গুরুত্ব সাম্প্রতিককালে তাদের কাছে আরও বেড়ে গেছে।

অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমাদের গত চারটি সাধারণ নির্বাচন মোটামুটিভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল এবং সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করেছে বলে অনেক উন্নয়ন সহযোগীরই ধারণা। এসব নিয়ে তাদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে সোচ্চারও হয়েছে, যাতে সরকারের কোনোরূপ টনক তো নড়েইনি, বরং তারাই পরবর্তী সময়ে সমালোচনার শিকার হয়েছে।

নে রাখা প্রয়োজন, পশ্চিমা দেশগুলোর হাতে বিশ্বব্যাংকের অধিকাংশ মালিকানা। আমাদের আশঙ্কা যে মালিকদের ক্ষোভ ও রাজনৈতিক বিবেচনা বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত পরোক্ষভাবে হলেও প্রভাবিত করেছে। তাই বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত বদলাতে হলে দুর্নীতির অভিযোগের সুরাহাসহ যথাসময়ে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আমাদের রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে এবং অন্য আনুষঙ্গিক সমস্যাগুলোর সমাধান করার ব্যাপারে সরকারকে আন্তরিকতা প্রদর্শন করতে হবে।

আর বিশ্বব্যাংক ও এডিবির সঙ্গে আমাদের সমঝোতায় আসতেই হবে। আমাদের উন্নয়ন সহযোগিতার সিংহভাগ আসে এই দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন সহযোগিতা পাওয়ার প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হচ্ছে। আমাদের চলমান একগুঁয়েমিপনা এ সহযোগিতা অব্যাহত থাকার পথে একটি বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, যা আমাদের জন্য কল্যাণকর হবে না।

আরেকটি বিষয়ও প্রাসঙ্গিক। ২০০৬-০৮ সালে বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূরীকরণের লক্ষ্যে অনেক উন্নয়ন সহযোগীই প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিল, যার জন্য তারা অনেক সমালোচনারও সম্মুখীন হয়েছিল। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদেরা সে সময়কার অভিজ্ঞতা থেকে কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করেননি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের পশ্চিমা সহযোগীরা আমাদের ‘হাতে মারার চেয়ে ভাতে মারা’র পথই বেছে নিয়েছে বলে মনে হয়। পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত এ মনোভাবেরই প্রতিফলন বলে আমাদের আশঙ্কা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভাতে মারার এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারটি যদি সত্য হয়, অনাগ্রহী ভুক্তভোগী হবে এ দেশের সাধারণ মানুষ, রাজনীতিবিদেরা নন। আর এ নীতি অব্যাহত থাকলে এবং আমাদের রাজনীতিবিদেরা দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দিলে, ভবিষ্যতে আমাদের জন্য আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে বলেই আমাদের আশঙ্কা।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।

সূত্র: প্রথম আলো, ১৩ জুলাই ২০১২

Related Post

বিশেষ অধিকার ও গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতাবিশেষ অধিকার ও গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা

সংসদ বদিউল আলম মজুমদার কয়েক সপ্তাহ আগে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দু’জন বিচারকের বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণ এবং পরে তা প্রত্যাহারের বিষয়ে তদন্ত করার লক্ষ্যে

সুশাসন: আজ জাতীয় ঐক্য জরুরিসুশাসন: আজ জাতীয় ঐক্য জরুরি

বদিউল আলম মজুমদার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যহীন একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সৃষ্টি করা আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। এ লক্ষ্যেই ১৯৭১ সালে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন এবং অনেকে প্রাণও দিয়েছেন। আমাদের সংবিধানেও এ