সাংসদেরা কি লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত?

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ০১-০৯-২০১২

আমাদের সংসদ সদস্যরা কি ‘অফিস অব প্রফিট’ বা প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত—এ প্রশ্ন নিয়ে সম্প্রতি একটি বিতর্ক শুরু হয়েছে। ব্যারিস্টার হারুন উর রশিদের মতে, তাঁরা অবশ্যই লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত (দ্য ডেইলি স্টার, ১৬ আগস্ট ২০১২)। পক্ষান্তরে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের বক্তব্য যে তাঁরা লাভজনক পদে আসীন নন। এ বিতর্ক অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক; কারণ, এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়বে আমাদের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী, ‘সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে—(ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে, সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে, ভাঙিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে …’ [অনুচ্ছেদ ১২৩(৩)(ক)]। অর্থাৎ আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংসদ সদস্যরা তাঁদের পদে বহাল থাকাকালীন অবস্থায়। আর তাঁরা যদি প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে আসীন থাকেন, তা হলে তাঁরা পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। কারণ, আমাদের সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি…(ঘঘ) আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করিতেছে না, এমন পদ ব্যতীত তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন…।’

আর সংবিধানের ৬৬(২-এ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে কোনো ব্যক্তি কেবল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপ-মন্ত্রী হইবার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন না।’ অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদেরকেই শুধু প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এবং তাঁরা সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য নন।

যেহেতু সুনির্দিষ্ট করে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিতদের প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদ অধিষ্ঠিত নয় বলে সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া হয় যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অন্যান্য যাঁরা বেতন-ভাতা পান, তাঁরা প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত এবং সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য। আর সংসদ সদস্যরা যেহেতু রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা পান এবং তাঁরা সাংবিধানিকভাবে অব্যাহতিপ্রাপ্ত নন, তাই তাঁরা প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত, ফলে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে অযোগ্য।

কিন্তু কোনো ব্যক্তি সরকারি কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা বা অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পেলেই কি তিনি প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলে গণ্য হবেন? এটি কি সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? প্রজাতন্ত্রের অফিস অব প্রফিট বা লাভজনক পদ বলতেই বা কী বোঝায়? এ ছাড়া ‘অফিসে’ এবং ‘প্রফিটে’র সংজ্ঞাই বা কী?

সংবিধান-বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলামের মতে, ‘লাভজনক পদ বলতে এমন পদকে বোঝায়, যা থেকে লাভ অর্জন করা সম্ভব।’ (‘An office of profit means an office capable of yielding profit.’ [Constitutional Law of Bangladesh (Dhaka: Mullick Brothers, 2008), 2nd ed., p. 344]. কোনো ব্যক্তি ‘অফিসে’ অধিষ্ঠিত না হলে, তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হবেন না, যদিও তিনি ‘প্রফিট’ বা লাভ অর্জন করেন। (‘If a person does not hold an office, he is not disqualified even if he is making profit.’) আর হোয়ারটনস ল’ লেক্সিকন (Wharton’s Law Lexicon) অনুযায়ী, অফিসের অর্থ চাকরি, যা হতে পারে বিচারিক, স্থানীয় সরকারের, বেসামরিক, সামরিক, যাজকের চাকরি; এবং প্রফিটের অর্থ আর্থিক সুযোগ-সুবিধা। তবে অফিস বা পদ হতে হবে স্থায়ী ও গুরুত্বপূর্ণ।

প্রফিটের ক্ষেত্রে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি, মর্যাদা বা অন্য সুযোগ-সুবিধা পেলে হবে না। আর্থিক সুযোগ-সুবিধাও হতে হবে ‘কম্পেন্সেটরি অ্যালাউন্স’-এর বা দায়িত্ব পালনের জন্য নিজ পকেট থেকে যা ব্যয় হয়েছে তার চেয়ে বেশি। অর্থাৎ লাভজনক পদ নির্ধারণে আর্থিক সুযোগ-সুবিধার পরিমাণও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা।

তবে প্রফিট বা লাভ অর্জন করলেই বা লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত হলেই হবে না, সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য একজন ব্যক্তি অযোগ্য হবেন না, যদি তিনি ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে’ নিয়োজিত বা প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে আসীন না হন। সংবিধানের ১৫২(১) অনুযায়ী, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম অর্থ আধাসামরিক বা সামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকার-সংক্রান্ত যে কোনো কর্ম, চাকুরী বা পদ এবং আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্ম বলিয়া ঘোষিত হইতে পারে, এইরূপ অন্য কোনো কর্ম।’

আর সরকারি কোষাগার থেকে কোনো ব্যক্তি বেতন-ভাতা বা অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পেলেই তিনি সরকারের অধীনে লাভজনক পদে নিয়োজিত আছেন বলে নিশ্চিত করে বলা যায় না। তা নির্ভর করে পদ এবং পদাধিকারীর ক্ষেত্রে সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ কতটুকু আছে তার ওপর। আর সরকারের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপকতা নির্ভর করে কতগুলো মানদণ্ডের ওপর। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট, গুরু গোবিন্দ বসু বনাম শঙ্করি প্রসাদ ঘোষাল (এআইআর ১৯৬৪ এসসি ২৫৪) মামলার যুগান্তকারী রায়ে এসব মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছেন। মানদণ্ডগুলো হলো: (১) সরকার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কি না; (২) সরকারের নিয়োগ বাতিলের ক্ষমতা আছে কি না; (৩) সরকার বেতন-ভাতা নির্ধারণ করে কি না; (৪) কোন উৎস থেকে বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়; এবং (৫) পদাধিকারী কীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন, তা নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের আছে কি না।’

পদাধিকারী ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত আছেন কি না, তা নির্ভর করে সবগুলো মানদণ্ড পূরণের ওপর। তবে কোন মানদণ্ড বেশি গুরুত্ব পাবে, তা নির্ভর করবে ‘সারকামস্টেন্সেসে’র অবস্থা বিশেষের ওপর [P.D.T. Achary, Law & Practice Relating to Office of Profit (New Delhi: Bharat Law House, 2006), পৃ. ১৭] অর্থাৎ এসব মানদণ্ড ঢালাওভাবে প্রয়োগ করা যায় না। অর্থাৎ অন্যভাবে বলতে গেলে, সংসদ সদস্যরা লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত, তবে প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নয়। সরকার তাঁদেরকে নিয়োগ দেয় না বা বরখাস্ত করতে পারে না। তাঁরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার কারণে সরকারি বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। ভারতীয় আদালত ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের এ বিষয়ে একাধিক রায় রয়েছে এবং এসব রায়ে লোকসভা/রাজ্যসভার সদস্য ও প্রাদেশিক পরিষদের বিধায়কেরা সরকারের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত এবং সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য নন বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

তবে কেউ যদি সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে লিপ্ত হন, তবে তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য হবেন না। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৭৭ সালে জানা যায় যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের স্পিকার মি. এ্যাংলিন একটি খবরের কাগজের ছাপাখানার মালিক হিসেবে পোস্ট অফিসে ফরম সরবরাহ করার কারণে সরকারের একজন ঠিকাদার। বিষয়টি তখন বিশেষ অধিকার ও নির্বাচনসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির কাছে প্রেরণ করা হয়, যে কমিটি তাঁকে নির্বাচনে অযোগ্য বলে ঘোষণা করে। আমাদের সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইন, ১৯৭২-এর ১২(১)(ট) ধারা অনুযায়ীও, ‘কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য হবার এবং থাকবার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে লিপ্ত থাকেন।’ প্রসঙ্গত, আমাদের অন্তত দুজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে সরকারের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে (প্রথম আলো, ১০ আগস্ট, ২০১২), যদিও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হয়নি।

পরিশেষে, সংসদের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জটিলতা সম্পর্কে—যে ইস্যু নিয়ে আমাদের দেশে এখন বিতর্ক চলছে—ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি সুস্পষ্ট রায় রয়েছে। ভাগওয়াতি প্রসাদ দীক্ষিত ঘোষাল বনাম রাজীব গান্ধী (এআইআর ১৯৮৬ এসসি ১৫৩) মামলার রায়ে আদালত বলেন: ‘ভারতীয় ‘সংবিধানের ১০২(১)(ক) অনুচ্ছেদ [যা বাংলাদেশ সংবিধানের প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ-সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ ৬৬(২)(ঘঘ)-এর সমতুল্য] এবং ১০৬ অনুচ্ছেদ [যা বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৮-এর সমতুল্য] একত্রে ব্যাখ্যা করা আবশ্যক। যখন এগুলো এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, তখন বলা যাবে না যে বেতন-ভাতা পাওয়ার কারণে লোকসভা বা উচ্চকক্ষের সদস্যরা সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার জন্য অযোগ্য হবেন। যা হোক, ‘সংসদ সদস্যপদ সরকারের অধীনে লাভজনক পদ নয়। তাই নির্বাচনের সময়ে লোকসভা ভেঙে দেওয়া হয়নি বলে যে লোকসভার বিবাদী একজন সদস্য ছিলেন, তিনি পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য হবেন না…সুতরাং বিদ্যমান লোকসভার ভেঙে দেওয়া সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বশর্ত নয়।’

তবে আমাদের নবম সংসদের সদস্যরা তাঁদের সদস্যপদ বহাল রেখে দশম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে আইনগত বাধা না থাকলেও, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না বলেই আমাদের আশঙ্কা।
 ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।

সূত্র: প্রথম আলো, ১ সেপ্টেম্বর ২০১২

Related Post

রাজনীতি: আ.লীগ-বিএনপি দ্বন্দ্বের অবসান জরুরিরাজনীতি: আ.লীগ-বিএনপি দ্বন্দ্বের অবসান জরুরি

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ০৭-০১-২০১০ গত ৫ ডিসেম্বর ২০০৯ প্রথম আলোতে প্রকাশিত নিবন্ধে অধ্যাপক এম এম আকাশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বন্দ্বের স্বরূপ তুলে ধরেছেন এবং এর সম্ভাব্য পরিণতির

উপনির্বাচন: জাতির সামনে আরেকটি অগ্নিপরীক্ষাউপনির্বাচন: জাতির সামনে আরেকটি অগ্নিপরীক্ষা

বদিউল আলম মজুমদার জাতীয় সংসদের সাতটি আসনের উপনির্বাচন ২ এপ্রিল। ইতিমধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া ও প্রত্যাহারের তারিখ পার হয়ে গেছে। এসব নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

সংবিধান না মানাও সংবিধানের প্রতি অবমাননাসংবিধান না মানাও সংবিধানের প্রতি অবমাননা

স্থানীয় সরকার0 বদিউল আলম মজুমদার সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাসের পর বেগম খালেদা জিয়া সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। এটি রাজনৈতিক বক্তব্য হলেও নিন্দনীয়। এর মাধ্যমে সংবিধানকে, যা দেশের সর্বোচ্চ