সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক গোলটেবিল বৈঠক সুজন-এর উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের শিক্ষাধারার গতিপ্রকৃতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

সুজন-এর উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের শিক্ষাধারার গতিপ্রকৃতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

????????????????????????????????????

বর্তমান শিক্ষা বছরে সরকার প্রণীত পাঠ্যপুস্তকসমূহের অমার্জনীয় ভুল ও অনাকাক্ষিত পরিবর্তনসমূহ নিয়ে সমাজের সকল স্তরে বিভ্রান্তি ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এটি একাধারে যেমন পেশাদারিত্বের ঘাটতি, তেমনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকেও আলোচনায় নিয়ে এসছে। এ নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যেমন বিপাকে পড়েছে; তেমনি সচেতন মহলেও বাংলাদেশের শিক্ষাধারার গতিপ্রকৃতি নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা ধরণের প্রশ্ন। এ পেক্ষাপটে আজ ৩১ জানুয়ারি ২০১৭, সকাল ১০.০০টায়, জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘বাংলাদেশের শিক্ষাধারার গতিপ্রকৃতি’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়।

গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুজন নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, জাতীয় কমিটির সদস্য ড. স্বপন আদনান, জনাব সঞ্জীব দ্রং ও জনাব রোবাবায়েত ফেরদৌস, শিক্ষাবিদ ড. শরিফা খাতুন, রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনো ও রুহিন হোসেন প্রিন্স, এস এম আলী আজম, তপন কুমার দাস, সুজন ঢাকা জেলা কমিটির সম্পাদক বীরমুক্তিযোদ্ধ এম এন ইসলাম তপন চৌধুরী ও মহানগর কমিটির সম্পাদক জনাব সেলিমা মসির প্রমূখ। অনুষ্ঠানে সভপতিত্ব করেন সুজন ঢাকা জেলা কমিটির সভাপতি প্রকৌশলী মুসবাহ আলীম। সঞ্চালনা করেন সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।

আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাবর্তার সম্পাদক অধ্যাপক এ এন রাশেদা। তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে যে পাঠ্যপুস্তক দেয়া হলোÑ তা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত বিদ্যোৎসাহী জনগোষ্ঠীর মাঝে, তার সঙ্গে দেখা দিয়েছে হতাশাও।’

তিনি বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন সম্পর্কে আলোচনার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ক্রটি তুলে ধরেন।

প্রবন্ধের শেষভাগে পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তসমূহ বেদনাদায়ক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বই থেকে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হুমায়ুন আজাদের ‘বই’ কবিতা, ষষ্ঠ শ্রেণীর বাংলা বইয়ে এসে ওয়াজেদ আলীর ‘রাঁচি ভ্রমণ’, সপ্তম শ্রেণীর বাংলা বইতে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘লাল ঘোড়া’ এবং কালিদাস রায়ের ‘অপূর্ব প্রতিশোধ’ কবিতা ইসলামের প্রশংসা করে লেখা হয়েছে তবুও কবিতাটি বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়েছে স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘উপদেশ’ কবিতাও। রণেশ দাশগুপ্তের ‘মাল্যদান’ গল্পে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফুটে উঠেছে; অথচ এটাও বাদ পড়েছে। মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরে ঘরে পবিত্র কোরআন, বেদ ও গীতার পরে সর্বাধিক পঠিত লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘লালু’ বাদ দেওয়ার হয়েছে। অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে রবীন্দ্রোত্তর যুগের বাংলা সাহিত্যের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বুদ্ধদেব বসুর ‘নদীর স্বপ্ন’ কবিতাটি বাদ দেয়া হয়েছে। উপ্রন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী রচিত ‘রামায়ণ কাহিনী-আদিখণ্ড’ শীর্ষক গল্পটি বাদ পড়েছে। নবম শ্রেণীর বাংলা বইতে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘পালামৌ’ গল্পটি বাদ দেওয়া হয়েছে। জ্ঞানদাস রচিত ‘সুখের লাগিয়া’ কবিতাটি বাদ পড়েছে। বাদ পড়েছে ভারতচন্দ্র গুণাকর রচিত ‘আমার সন্তান’ কবিতাটি। বাঙলার মানবতাবাদী সংস্কৃতির প্রতীক মরমী সাধক লালন শাহ রচিত ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ কবিতাটি বাদ পড়েছে। এ তালিকায় আরো আছে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা’, জনপ্রিয় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতাটি বাদ দেওয়া হয়েছে।’

প্রবন্ধের শেষভাগে তিনি বলেন, ‘আমরা কি আলোচনা করেই শেষ করব? নাকি সরকারের কাছে দাবি জানাবো_সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত দেশ গড়তে অসাম্প্রদায়িক পাঠ্যপুস্তক চাই মর্মে।’

ড. শরিফা খাতুন বলেন, ‘শিশুদের যা শিখানো হয় তারা তাই শিখে। তাই আমরা পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে কী শিখাচ্ছি তা গুরুত্বপূর্ণ।’ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পাঠ্যপুস্তক লেখা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য হলোÑ চিন্তা করা, নিজেকে বিকশিত করা এবং প্রশ্ন করার ক্ষমতা তৈরি করা। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থার বিকৃতি ঘটছে। শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ, বাণিজ্যিকীকরণ ও রাজনৈতিকীকরণ করা হয়েছে। এরফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। এই প্রচেষ্টা আত্মঘাতী। এই প্রচেষ্টা আমাদেরকে অন্ধকারে নিয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘যারা শিক্ষার ইসলামীকরণ করার কথা বলছেন এটা তাদের জন্যই ক্ষতিকর। কারণ যতদিন মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠ ছিল ততদিন তারা শ্রেষ্ঠ ছিল।’ সরকার দ্রুত পাঠপুস্তকে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে এবং এই দাবি আদায়ে সবাই সোচ্চার হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

হায়দার আকবর খান রনো বলেন, ‘সরকার হেফাজতের দাবির মুখে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন এনেছে, এটি নিন্দনীয়। শিক্ষা আজ পণ্যে পরিণত হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন, যে যত বেশি টাকা দিতে পারবে তার জন্য শিক্ষা।’ তিনি তাঁর বক্তব্যে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি জানান।

ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষা একটি বিস্তৃত বিষয়। এর প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া দরকার। আমাদের বহুত্ববাদকে গুরুত্ব দেয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দেখছি আজকে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়া ছেড়ে দিচ্ছে, এর কারণ কী, তা অনুসন্ধান করা দরকার।’ চলতি শিক্ষাবর্ষে দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং উদাসীনতার কারণে পাঠ্যপুস্তকে ভুল ও পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন।

ড. স্বপন আদনান বলেন, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ওপর জোর দেয়ার কারণে ভাষাগত সাম্প্রদায়িকতা তৈরি হয়েছে। আর বর্তমানে দেখা দিয়েছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। আজকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পাশের হার বাড়ানো হচ্ছে। একইসঙ্গে বেসরকারি মালিকানায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। শিক্ষা যেন একটা প্রজেক্ট। এর মাধ্যমে আমরা মেধাশূন্য জাতি গড়ে তুলছি।’

ড. রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা কি শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষ বানাতে চাই, নাকি হিন্দু বা মুসলমান বানাতে চাই। আমরা চেয়েছিলাম মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিক করতে, অথচ আজকে সাধারণ শিক্ষার মাদরাসাকরণ হচ্ছে। এটি দুঃখজনক।’

সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে সরকার ভুলে ভরা বই শিশুদের হাতে তুলে দিয়েছে। আমাদের শিশুদের এমন শিক্ষাই দেয়া উচিত যা তাদেরকে সকল মতের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলবে।’

রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘একদিকে শিক্ষাব্যবস্থার সাম্পদায়িক রূপ দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষায় বিনিয়োগ কম করা হচ্ছে।’ অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে একমুখী ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মূল প্রবন্ধ পড়তে এখান ক্লিক করুন

Related Post

“সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচনের লক্ষ্যে করণীয়” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত“সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচনের লক্ষ্যে করণীয়” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, সকাল ১০.০০টায় ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর আয়োজনে জাতীয় প্রেস ক্লাব অডিটোরিয়াম এ “সুষ্ঠু ও অর্থবহ নির্বাচনের লক্ষ্যে করণীয়” শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সুজনের নির্বাহী সদস্য

সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর উদ্যোগে ‘রোহিঙ্গা সমস্যা: বর্তমান পরিস্থিতি ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিতসুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর উদ্যোগে ‘রোহিঙ্গা সমস্যা: বর্তমান পরিস্থিতি ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের জন্য জাতীয় ঐক্য আজ একান্ত জরুরি_ এমনি মন্তব্য করেছেন ‘সুজন_সুশাসনের জন্য নাগরিক’ নেতৃবৃন্দ। আজ ১২ অক্টোবর ২০১৭, সকাল ১০.০০টায়, জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সুজন আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা সমস্যা:

“সুশাসন ও উন্নয়ন: প্রেক্ষিত উপজেলা নির্বাচন” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত“সুশাসন ও উন্নয়ন: প্রেক্ষিত উপজেলা নির্বাচন” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত

গত ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ ‘স্বশাসিত ইউনিয়ন পরিষদ এডভোকেসি গ্রুপ-বাংলাদেশ’ ও ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর যৌথ উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাব-এর ভিআইপি লাউঞ্জে একটি গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সুজন-এর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কাজী এবাদুল