সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক Uncategorized সুশাসন: সংসদীয় কমিটি বনাম দুদক: নাগরিক ভাবনা

সুশাসন: সংসদীয় কমিটি বনাম দুদক: নাগরিক ভাবনা

palo_logo
বদিউল আলম মজুমদার
সংসদীয় ‘সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি’ ও দুদকের মধ্যে বর্তমানে একটি গুরুতর বিরোধ দেখা দিয়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগে কমিটি দুদকের বিদায়ী চেয়ারম্যান জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরী, অপর দুজন কমিশনার ও সাবেক সচিবকে কমিশনের গত দুই বছরের কার্যক্রম সম্পর্কিত দলিলপত্রসহ ১২ এপ্রিল কমিটির সামনে তলব করে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁদের তলব করা আইনসংগত হয়নি বলে দাবি করে কমিটির সামনে উপস্থিত হতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। কমিটি তাঁদের কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করে ২ জুনের মধ্যে জবাব প্রেরণের জন্য বলে। একই সঙ্গে দুদকের সাবেক সচিবের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রী পরিষদকে অনুরোধ করে। জবাব সন্তোষজনক না হলে কমিটি তাঁদের বিরুদ্ধে সংসদ অবমাননার অভিযোগ এনে জেল-জরিমানার হুমকিও প্রদান করে।
নাগরিক হিসেবে আমরা আনন্দিত যে অন্তত একটি সংসদীয় কমিটি তার দায়িত্বকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এবং কমিটির সদস্যরা সক্রিয় হয়েছেন। কমিটিগুলো সংসদের প্রাণস্বরূপ এবং এগুলোর ফলপ্রসূতার ওপরই সংসদের কার্যকারিতা বহুলাংশে নির্ভরশীল। তবে বর্তমান বিরোধ সংসদীয় কমিটির কার্যপরিধি এবং সংসদে পাস করা আইনে সৃষ্ট একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতার সীমানা সম্পর্কিত কিছু গুরুতর প্রশ্নের উদ্রেক করে। আমরা আশা করি যে বিরোধটি সংবিধান, আইন, নৈতিকতা ও জনকল্যাণবোধের আলোকে নিষ্পত্তি হবে।
দুদক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নয়, তাই এটি সম্পর্কে সংবিধানে কিছু বলা নেই। সম্ভবত আমাদের সংবিধানপ্রণেতাদের ধারণার মধ্যেই আসেনি যে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা আমাদের এই বাংলাদেশ একদিন পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত জাতির অমর্যাদা ও গ্লানি অর্জন করবে। তাই তাঁরা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় একটি দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করেননি।
তবে সংসদ ও সংসদীয় কমিটিগুলো সংবিধানের সৃষ্টি এবং সংবিধানে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুনির্দিষ্ট করা আছে। আরও সুনির্দিষ্ট করা আছে, সংসদীয় ‘কার্যপ্রণালী-বিধি’তে। সংবিধানের ৭৬(১)(২) অনুচ্ছেদের অধীনে এবং কার্যপ্রণালী-বিধির ২৭তম অধ্যায়ের বিধানাবলির ভিত্তিতে স্থায়ী কমিটিগুলো গঠিত। সংবিধানের ৭৬(৩) অনুচ্ছেদ এবং কার্যপ্রণালী-বিধির ২০২, ২০৩, ২০৪ ও ২০৫ ধারার অধীনে কমিটিগুলোকে সাক্ষী ও দলিলপত্র তলবের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
কার্যপ্রণালী-বিধি ২৩৮ ধারার অধীনে ‘চতুর্থ তফসিলে লিপিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যাবলি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য’ সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির সৃষ্টি। ‘চতুর্থ তফসিলে লিপিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের রিপোর্ট ও হিসাব পরীক্ষা করা’ কমিটির কাজের অন্তর্ভুক্ত। আরও অন্তর্ভুক্ত ‘চতুর্থ তফসিলে লিপিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যাপারে সরকারি হিসাব কমিটি এবং অনুমিত হিসাব কমিটিতে ন্যস্ত ওইসব কাজ করা, … এবং যেসব কাজ সময়ে সময়ে স্পিকার কমিটিতে প্রেরণ করিবেন, তাহা করা’। তবে ‘যে বিশেষ আইন বলে কোনো বিশেষ সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়, সেই আইন বলে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানের বিবেচ্য বিষয়সমূহ’ কমিটির তদন্তের এখতিয়ার-বহির্ভূত। উল্লেখ্য যে কার্যপ্রণালী-বিধির বিধান পড়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির সৃষ্টি হয়েছে মূলত ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে।
অবশ্যই সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির সুনির্দিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম তদন্ত করার এবং সাক্ষী তলব করার এখতিয়ার রয়েছে। তবে কার্যপ্রণালী-বিধির চতুর্থ তফসিলে উল্লিখিত কমিটির এখতিয়ারাধীন ২৩টি ‘আইন/রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা স্থাপিত সরকারি প্রতিষ্ঠানে’র মধ্যে দুদক অন্তর্ভুক্ত নয়। এমনকি চতুর্থ তফসিলের ২৫ নম্বরে উল্লিখিত ‘এই বিধিসমূহ পাসের পর গঠিত অন্যান্য করপোরেশন/প্রতিষ্ঠান’ কমিটির আওতাভুক্ত করার বিধানও দুদকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়−দুদককে কমিটির এখতিয়ার থেকে বাইরে রাখা হয়েছে। কারণ দুদক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০০৪ সালে আর কার্যপ্রণালী বিধির সংশোধনের সর্বশেষ তারিখ ১১ জানুয়ারি, ২০০৭। অর্থাৎ দুদকের কার্যক্রম সংসদীয় স্থায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির এখতিয়ার-বহির্ভূত।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্পাদিত আইন-শব্দকোষ অনুযায়ী, দণ্ডবিধির ৪১ ধারা অনুসারে, ‘বিশেষ আইন হইতেছে বিশেষ বিষয়ের প্রতি প্রযোজ্য আইন।’ যেমন, রেলওয়ে আইন, আয়কর আইন ইত্যাদি। উপরিউক্ত সংজ্ঞার আলোকে ‘দুর্নীতি এবং দুর্নীতিমূলক কার্য প্রতিরোধের লক্ষ্যে দুর্নীতি এবং অন্যান্য সুনির্দিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান এবং তদন্ত পরিচালনার জন্য একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা’র (আইনের মুখবন্ধ থেকে উদ্ধৃত) লক্ষ্যে প্রণীত দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-ও ‘বিশেষ সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে’র লক্ষ্যে একটি বিশেষ আইন বলে আমাদের ধারণা। উপরনতু, দুদকের তদন্ত ‘সরকারি হিসাব কমিটি এবং অনুমিত হিসাব কমিটিতে ন্যস্ত’ বা স্পিকার কর্তৃক কমিটিতে প্রেরিত বিষয় বলেও আমরা শুনিনি। এসব বিবেচনায়ও দুদকের এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কার্যক্রম তদন্ত করা কমিটির কার্যপরিধির অন্তর্ভুক্ত নয়।
আরেকটি কারণেও দুদকের বিষয়ে কমিটির হস্তক্ষেপ বেআইনি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান না হলেও, দুদক আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান। দুদকের আইনের মুখবন্ধে এটিকে ‘দেশে দুর্নীতি এবং দুর্নীতিমূলক কার্য প্রতিরোধের লক্ষ্যে দুর্নীতি এবং অন্যান্য সুনির্দিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান এবং তদন্ত পরিচালনার জন্য একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধানকল্পে প্রণীত আইন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই কমিশন একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন হইবে।’ আইনের ২৪ ধারা অনুযায়ী, ‘এই আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে, কমিশনারগণ এই আইনের অধীন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।’ কমিশন যাতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মতো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সে লক্ষ্যে আইনের ১০(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক যেরূপ কারণ ও পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন, সেই রূপ কারণ ও পদ্ধতি ব্যতীত কোনো কমিশনারকে অপসারণ করা যাইবে না।’
আইনের উপরিউক্ত বিধানাবলি দুদককে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জাতীয় সংসদের প্রত্যয়েরই প্রতিফলন। যে প্রেক্ষাপটে তা করা হয়েছে, তাও আজ বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। বহুদিন থেকেই আমাদের দেশে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে এবং এটি এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা পছন্দের ব্যক্তিদের অন্যায় সুযোগ-সুবিধা দিলে বা ব্যক্তিগতভাবে নিলে দুর্নীতির সৃষ্টি হয়। ক্ষমতার, বিশেষত, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমেই আমাদের সমাজে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে। ‘দুর্নীতির রাজনীতিকরণে’র ফলে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায়ই দুর্নীতি আমাদের দেশে সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি আর দুর্নীতি আজ বহুলাংশে সমার্থক হয়ে গেছে, ফলে অতীতের দুর্নীতি দমনের প্রচেষ্টা অনেকের কাছে ‘রাজনীতি দমনে’র প্রচেষ্টা হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। আর রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করেই অতীতে দুর্নীতিরোধের সকল প্রচেষ্টা অকার্যকর করা হয়েছে। অনেকের ধারণা, এ ধরনের অপচেষ্টা রোধের লক্ষ্যেই জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ দুদককে স্বাধীন করেছে এবং তাদের অপসারণের বিরুদ্ধে কঠোর বিধান করে দুদকের কমিশনারদের নির্ভয়ে ও বিনা দ্বিধায় কাজ করার ক্ষমতা দিয়েছে, যদিও গত সরকার কমিশনকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করে রেখেছিল। বস্তুত, বর্তমানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা এড়ানোর জন্যই সংসদ দুদককে স্বাধীন করেছে বলে অনেকে মনে করেন।
নিঃসন্দেহে দুদক একটি সরকারি অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। সুপ্রিম কোর্ট, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন ইত্যাদিও সরকারি অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংবিধান এগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দিয়েছে এবং এগুলোর কাজে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কোনো সংসদীয় কমিটির নেই। আর সার্বভৌম সংসদে পাস করা আইন দুদককে স্বাধীনতা দিয়েছে−দুদক নিজে এ স্বাধীনতা ঘোষণা করেনি। তাই কার্যপ্রণালী-বিধির ২৩৮ ধারা ও চতুর্থ তফসিলের কথা বাদ দিলেও, আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনেও হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির নেই। যেমন নেই বাংলাদেশ ব্যাংকে।
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে সরকারি বা জনগণের অর্থে পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠানই দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিধান আইনে থাকা আবশ্যক। দুদকের আইনেও তা রয়েছে। আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী, ‘(১) প্রতি পঞ্জিকা বৎসরের মার্চ মাসের মধ্যে কমিশন পূর্ববর্তী বৎসরে সম্পাদিত উহার কার্যাবলি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবে। (২) এই ধারার অধীন প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর রাষ্ট্রপতি উহা জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের ব্যবস্থা করিবেন।’ এ ছাড়া সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে দুদকের কমিশনারদের অপসারণের বিধান রয়েছে। স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার এসব বিধান যদি অপ্রতুল মনে হয়, তাহলে আইন সংশোধনের মাধ্যমে এগুলোর পরিবর্তন করা যেতে পারে। কিনতু বর্তমান আইনে রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধতা এবং রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সংসদের কাছে স্বচ্ছতার বিধান অন্তর্ভুক্ত এবং তা-ই সবার জন্য পালনীয়। তবে দুদকের গত দুই বছরের কার্যক্রম সম্পর্কে অনেক অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে−আমরা জানি না এগুলোর কতটুকু উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তবুও সকল সন্দেহ দূর করে দুদকের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি বিচারবিভাগীয় তদন্তের কথা ভাবা যেতে পারে।
নাগরিক হিসেবে আর একটি বিষয় আমাদের ভাবিয়ে তোলে। কমিটির সভাপতি দুদকের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত, যে দণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি আপিল দায়ের করেছেন। তিনি একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এবং কয়েক মাস ধরে তিনি দুদক ও যাঁরাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার তাঁদের কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে আসছেন। দুদকের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখন সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ ব্যবহার করে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে বিচারকের আসনে বসেছেন। প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসার মতে, তিনি একাধারে জজ, প্রসিকিউটর ও জুরির আসনে বসেছেন। একজন অভিযুক্ত অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে বিচারকের আসনে বসতে পারেন না−এটি একটি পুরোনো আইনি প্রথা। তাই অনেকেই কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে ‘মেলাফাইডি ইনটেনশন’ বা অসৎ উদ্দেশ্যের অভিযোগ তুলেছেন। দুদকের কার্যক্রমে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হিসেবে কমিটির সভাপতির পদ ব্যবহার না করে তিনি ব্যক্তি হিসেবে আইনের আশ্রয়ও নিতে পারতেন। এ প্রসঙ্গে নাগরিক হিসেবে আমাদের আরও প্রশ্ন−কমিটির কার্যক্রমের মাধ্যমে কি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে? না প্রতিশোধ চরিতার্থ করার শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে?
সংসদীয় কমিটি এবং দুদকের মধ্যকার চলমান বিরোধ প্রসঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন−সংসদীয় কমিটির ক্ষমতা কি সীমাহীন? কমিটি কি রাতকে দিন করতে পারে? তাঁদের দায়বদ্ধতার জায়গাই বা কোথায়? পাঁচ বছর পর নির্বাচনের মুখোমুখি হওয়াই কি দায়বদ্ধতা? পাঁচ বছর মেয়াদকালীন অন্যায় আচরণ ও অসদাচরণের জন্য তাঁদের কোনোরূপ জবাবদিহিতা করতে হবে না? প্রসঙ্গত, ইন্দিরা গান্ধীকে ১৯৭৮ সালে দুর্নীতির প্রশ্রয় ও অসদাচরণের মাধ্যমে সংসদের বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন করে সংসদ অবমাননার অভিযোগে লোকসভা থেকে অপসারণ এবং কারারুদ্ধ করা হয়। এ পর্যন্ত দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগে ১৯৫১ সালে মুডগাল থেকে শুরু করে অন্তত ডজনখানেক সাংসদ ভারতীয় রাজ্যসভা ও লোকসভা থেকে বহিষ্কৃৃত হয়েছেন। এর মাধ্যমে তাঁদের দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিনতু দুর্ভাগ্যবশত, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের দেশ দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও এ পর্যন্ত আমাদের একজন সাংসদকেও ‘সাংসদদের অধিকার ক্ষুণ্ন’ করে সংসদ অবমাননার অভিযোগে সংসদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। এ ছাড়া অনেক দেশে সাংসদদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রিকল বা প্রত্যাহারের বিধান রয়েছে, যা আমাদের দেশে নেই।
এমনই অবস্থায় সংসদের তলব নীতিগত কারণে অমান্য করার অভিযোগে নাগরিকের বিরুদ্ধে−জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধূরী এখন একজন সাধারণ নাগরিক−সংসদ অবমাননার অভিযোগ উত্থাপনের হুমকি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। সরকারেরই একমাত্র বৈধভাবে বল প্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে। আমেরিকান জাতির পিতাদের অন্যতম জেমস্ মেডিসন কয়েক শতাব্দী আগে ‘ফেডারেলিস্ট’ পেপারে আগ্রাসী সরকারের কাছ থেকে নাগরিকের জান-মাল ও নিরাপত্তা বিধানের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন: ‘যদি মানুষ ফেরেশতা হতো, তাহলে সরকারের প্রয়োজন হতো না। যদি ফেরেশতারা মানুষকে শাসন করত, তাহলে বাইরের কিংবা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হতো না। মানুষ মানুষের দ্বারা শাসিত হবে এমন ব্যবস্থায় সরকারি কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সমস্যা হলো যে: প্রথমেই সরকার কর্তৃক শাসিতদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা; এবং পরবর্তী সময়ে শাসকদের নিজেদের নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা। জনগণের ওপর নির্ভর করা নিঃসন্দেহে সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক ধাপ; কিনতু অভিজ্ঞতা মানবজাতিকে শিখিয়েছে বাইরের নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বের কথা।’
জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত সংসদ সার্বভৌম, কিনতু এর ক্ষমতাও অসীম নয়−অসীম ক্ষমতার মালিক একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। আমাদের মতো দেশে লিখিত সংবিধান সংসদের ক্ষমতার পরিধি নির্ধারিত করে দিয়েছে। এমনকি ব্রিটেনে, যেখানে লিখিত সংবিধান নেই, সেখানেও পার্লামেন্ট ইচ্ছামতো সবকিছু করতে পারে না। তারাও অনেক সীমাবদ্ধতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। লেজলি স্টিফেনসের মতে, ‘পার্লামেন্টের ক্ষমতার ওপর ভেতর-বাহির উভয় দিক থেকেই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভেতর থেকে সীমাবদ্ধ, কারণ আইনসভা সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং যা কিছুই সমাজ তৈরি করে তারই সৃষ্টি। বাহির থেকে সীমাবদ্ধ, কারণ আইন প্রয়োগের ক্ষমতা নির্ভর করে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতার ওপর, যার পরিধিও সীমাবদ্ধ। আইনসভা যদি সকল নীল চোখসম্পন্ন শিশুকে খুন করার আইন করে, নীল চোখসম্পন্ন শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা হবে বেআইনি। কিনতু আইনসভার সদস্যদের উন্নাদ হয়ে যেতে হবে এ ধরনের আইন করার জন্য এবং প্রজাদেরও এমন আইন মেনে চলার জন্য চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতে হবে।’ [ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ ১৫ বিএলটি(এইচসিডি)(২০০৭) মামলার রায় থেকে উদ্ধৃত।] অর্থাৎ দায়িত্বশীলতা, নৈতিকতা, ন্যায়-নীতিবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ ও প্রেক্ষাপট, বিদ্যমান আইনি বিধি-বিধান, জনকল্যাণ ইত্যাদি মানদণ্ডের আলোকে সংসদ ও সংসদীয় কমিটিগুলোর কার্যপরিধির সীমাবদ্ধতা নিরূপিত হয়। তাই সংসদীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি ও দুদকের মধ্যকার বর্তমান বিরোধ এসব মানদণ্ডের আলোকেই মীমাংসা হতে হবে। এ ব্যাপারে বিচার বিভাগকেই রেফারির ভূমিকা পালন করতে হবে।
অনেকের আশঙ্কা, সংসদীয় কমিটির বর্তমান অবস্থান প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদককে ধ্বংস করে দেবে। ভবিষ্যতে হয়রানির ভয়ে কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক, যাদের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য, দুদকের সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহী হবেন না। ফলে আমাদের আশঙ্কা যে দুদক ভবিষ্যতে একটি পোষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। অতীতে পোষা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করার পরিণতি জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনি। সংসদীয় কমিটির বর্তমান কঠোর অবস্থান জনস্বার্থ সমুন্নত করবে কি না তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে। আইনের পাশাপাশি ন্যায়-নীতিবোধ ও জনস্বার্থও সংসদীয় কার্যক্রমের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন−সুশাসনের জন্য নাগরিক।
তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, ২৫ এপ্রিল ২০০৯

Related Post

“নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তথ্য উপস্থাপন এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বানে” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত“নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তথ্য উপস্থাপন এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বানে” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

গত ১১ ডিসেম্বর ২০১৬ সকাল ১১.৩০টায়, নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে সুজন নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটি আয়োজিত ‘নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিকারী প্রার্থীদের তথ্য উপস্থাপন এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান’

রাজনৈতিক সংকটের টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে জাতীয় সনদরাজনৈতিক সংকটের টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে জাতীয় সনদ

বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক একটি জাতীয় সনদ প্রণয়ন করে। গত ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সুজন-এর পঞ্চম জাতীয় সম্মেলনে জাতীয় সনদটি অনুমোদিত হয়। সুজন মনে করে

ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থীদের তথ্যের বিশ্লেষণ (সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধ)ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থীদের তথ্যের বিশ্লেষণ (সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধ)

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত তফসিল আনুযায়ী আগামী ২৮ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থী কর্তৃক হলফনামায় দাখিলকৃত