সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক গোলটেবিল বৈঠক সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে শেয়ার বাজারের কারসাজির সাথে জড়িতদের শাস্তি দাবি

সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে শেয়ার বাজারের কারসাজির সাথে জড়িতদের শাস্তি দাবি

“পুঁজিবাজারের অস্থিরতা নিয়ে নাগরিক উদ্বেগ” শীর্ষক সুজন এর গোলটেবিল বৈঠক
পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক অস্থিরতা নিয়ে সাধারণ নাগরিকের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ অস্থিরতার কারণে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বশাস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এ অস্থিরতার পেছনে রয়েছে সরকারি ও বিরোধী দলের সাথে জড়িত কিছু ক্ষমতাধরের কারসাজি। বিষয়টির ওপর আলোকপাত করার লক্ষ্যে সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক ২৪ মার্চ ২০১১, বিকেল ৩ টায় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে “পুঁজিবাজারের অস্থিরতা নিয়ে নাগরিক উদ্বেগ” শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছে। বৈঠকে “পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি:সমাধান কোন পথে?” শীর্ষক মূল প্র্বন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
ডিসেম্বর ২০১০ পূর্ব বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, প্রকৃত অর্থনীতিতে বিনিয়োগ সংকট দেখা দিয়েছে। বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১২.৭% যা বিগত ৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। জানুয়ারি ২০১১ শেষে ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার পরিমান দাঁড়ায় ২০,৬৬০ কোটি টাকা। স্বল্প ঝুঁকি ও স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফার আশায় পুঁজিবাজারে ব্যাপকহারে নতুন বিনিয়োগকারীর আগমন ঘটে। জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২০১০ সময়কালে পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ১৫% বেড়েছে। মোট বিও একাউন্টের সংখ্যা ডিসেম্বর ২০১০ পর্যন্ত ৩২ লক্ষ হলেও অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর পুঁজি বাজার সম্পর্কে রয়েছে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব। ৩২টি জেলায় ২৩৮টি ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে ৫৯০টি শাখা খোলা হয়েছে, বিভিন্ন জেলায় শেয়ার মেলা করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিনিয়োগকারীদের বিভিন্নভাবে আকৃষ্ট করা হয়েছে যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে।
বিশ্লেষণে উঠে আসে পুঁজি বাজারের ব্যবস্থাপনা ও তদারকিতে দুর্বলতার চিত্র। এসইসি মার্জিন ঋণের সিদ্ধান্ত বার বার পরিবর্তন করেছে। প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে লক-ইন সময় মানা হয়নি। রাইট শেয়ার ছেড়ে কোম্পানি টাকা তুলেছে। পুঁজিবাজারের অনিয়ম পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধানের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি এবং সফটওয়্যারের অভাব রয়েছে। এসইসিতে অডিট রিপোর্ট পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে। এসইসির মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল বলে তিনি উল্লেখ করেন। অর্থমন্ত্রণালয় ও এসইসি-এর সম্পর্কের মধ্যে সমস্যা এবং অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ’উপদেষ্টামূলক’ ভূমিকাও পুঁজি বাজার ব্যবস্থাপনায় অহেতুক চাপ ফেলেছে বলে তিনি জানান।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দূর্বল ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন দুর্বল কম্পিউটার ব্যবস্থা, ডিএসইতে সফটওয়্যারের ব্যবহার ’ত্র“টিপূর্ণ’, কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউজ ত্র“টিপূর্ণ থাকায় বাজার অকার্যকর হয়ে পড়ে। গবেষণায় উঠে আসে বাজারে অনৈতিক লেন-দেনের কথা। বাজারে কতিপয় ডিএসই/সিএসই পরিচালক, এসইসি’র কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বড় ব্যবসায়ী, ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং ব্রোকারেজ হাইজের মালিকরা জড়িত হয়েছে। আইপিওর প্লেসমেন্ট শেয়ার লেনদেন, কতিপয় কোম্পানীর জন্য ’লক-ইন’ সময়কাল উঠিয়ে দেয়া এবং জেড শ্রেণীভূক্ত শেযার এর দাম কৃত্রিমভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বুক বিল্ডিং পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানোর জন্য। দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থার জন্য এসইসি’র পক্ষ থেকে এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে পারেনি।
আর্থিক খাতেও অনিয়ম লক্ষ করা যায়। বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংক তাদের নির্দিষ্ট সীমার চেয়ে বেশী বিনিয়োগ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে মেয়াদী ঋণ, ওভারড্রাফট এর অর্থ পুঁজি বাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানা হয়নি। ৩৫টি মার্চেন্ট ব্যাংক থাকা সত্ত্বেও মোট আইপিও এসেছে মাত্র ২১টি। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রে ’ব্রোকারেজ হাউজ’ এর মতো আচরণ করেছে। বিভিন্ন ধরনের কারসাজির ফলে পতন ঘটে শেয়ার বাজারের।
গবেষক আলোকপাত করেন ডিসেম্বর ২০১০ পরবর্র্তী পরিস্থিতি নিয়ে। শেয়ার বাজার পতনের পর কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান। ৬টি কোম্পানীর বিরুদ্ধে আর্থিক হিসাব প্রকাশ না করার জন্য জরিমানা করা হয়েছে। বুক বিল্ডিং পদ্ধতি স্থগিত রাখা হয়েছে। ৫০০০ কোটি টাকার বাংলাদেশ ফান্ড গঠন করা হয়েছে; এসইসি আরো লোকবল নিয়োগ করতে যাচ্ছে; ৬টি ব্রোকারেজ হাইজের বিরুদ্ধে লেনদেন অনিয়মের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে; এসইসির ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা হয়েছে; ড. খন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পুঁজিবাজারের সংস্কার ও উন্নয়ন বিষয়ে তাঁর কতিপয় সুপারিশ প্রদান করেন গবেষক। উলেলখযোগ্য সুপারিশ হলো : পুঁজি বাজারে স্বল্প মেয়াদী লেনদেন নিরুৎসায়িত করা; আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট নিয়োগ এবং শক্তিশালী কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবস্থা স্থাপন করে এসইসি’র পর্যবেক্ষন ও মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালী করা; নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য শিক্ষামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা; এসইসি পরিচালনা পর্ষদ শক্তিশালী করা; লিস্টেড এবং নন-লিস্টেড কোম্পানীর করপোরেট ট্যাক্সের ব্যবধান বাড়ানো (বর্তমানের ১০% ব্যবধান বাড়িয়ে ২৫%করা যেতে পারে)। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয় জোরালোভাবে।
বিষয় সম্পর্কে মতামত তুলে ধরেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ, অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহম্মেদ খান,  সৈয়দ মাহবুব রশীদ, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
মাহবুব রশীদ (শেয়ারবাজারের সাবেক কর্মকর্তা) বলেন, এখানে কী বিনিয়োগ হয়েছে নাকি ফটকাবাজি হয়েছে তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। ৯৬ সালের ঘটনার কিন্তু ভালো তদন্ত  হয়েছিল। কিন্তু অপরাধীদের কোন বিচার হয়নি। অন্যায় করে পার পাওয়ার সংস্কৃতি থেকে আমাদের মুক্ত হওয়া প্রয়োজন।
প্রফেসর আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারের সাথে অবশ্যই পাবলিক ইন্টারেস্ট জড়িত। তিনি এসইসি‘কে দায়ী করে বলেন,  ক্ষমতা আর আইন দুটোই এসইসি‘কে দেয়া আছে। কিন্তু এসইসি দুর্নীতিগ্রসত হলে করার কিছু নেই। এখানে বেশিরভাগ দুর্নীতির সাথে এসইসির নাম জড়িত। ‘দয়া করে জনগণের টাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দিবেন না’-এমন একটা অনুরোধের মধ্যদিয়ে তিনি তার বক্তব্য শষে করেন।
অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এসইসি‘কে দায়ী করে বলেন, এ পরিস্থিতির দুটি কারন জড়িত আর তা হলো এক সরবরাহ ঘাটতি দুই পর্যাপ্ত মনিটরিং এর অভাব।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, তড়িৎগতিতে মুনাফার সম্ভাবনা এবং পুঁজি হারানোর সম্ভাবনা-দুটোই পুঁজিবাজারে স্বাভাবিক। তাই বিনিয়োগকারীদের বুঝে-শুনে বিনিয়োগ করা উচিত।  এসইসি কর্মকর্তাদের বিষয়ে তিনি বলেন, পেশাগত দক্ষতা, সততা আর নতজানু হয়ে কাজ না করার সামর্থ্য তাদের থাকা প্রয়োজন। সার্বিকভাবে একটা আস্থার পরিবেশ তৈরী করার প্রতি তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অতীতেও কারসাজি হয়েছে, কিন্তু কারো বিচার হয়নি। এ জন্য উৎসাহিত হচ্ছে এ ধরনের অপকর্ম। ১৯৮৬ সালের কারসাজির তদন্তের রিপোর্টে  ১১টি কোম্পানি এবং ১১জন ডিএসই মেম্বার ও ব্রোকারেজ হাউজকে দায়ী করা হয়। এদের যদি বিচার হতো তাহলে সাম্প্রতিক কারসাজি এড়ানো যেত। তিনি সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে শেয়ার বাজারের বর্তমান কারসাজির সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

Related Post

‘চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত‘চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

নির্বাচনই যথেষ্ট নয়, উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করার আহ্বান দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার ব্যবস’াকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা আমাদের সাংবিধানিক নির্দেশনা। অথচ স্বাধীনতার ৪৩

‘রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সংলাপ, সমঝোতা, সমাধান জরুরি’ – গোলটেবিল বৈঠকে বক্তাগণ‘রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সংলাপ, সমঝোতা, সমাধান জরুরি’ – গোলটেবিল বৈঠকে বক্তাগণ

গত ২৮ মে ২০১২, সকাল ১০ টায়, জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে, সুজনে’র উদ্যোগে ‘চলমান রাজনৈতিক সংকটের উত্তরণ কোন পথে’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই সদ্য প্রয়াত

দিনবদলের সনদের অঙ্গীকার ও বাস্তবতাদিনবদলের সনদের অঙ্গীকার ও বাস্তবতা

ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক (৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১১) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকারের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। ‘দিনবদলের’ অঙ্গীকারের ভিত্তিতে সরকার ক্ষমতায় এসেছে। গত ৬