সুসংবাদ নিয়ে সন্তুষ্টির অবকাশ নেই

samakal_logo
দুর্নীতি
বদিউল আলম মজুমদার
নিঃসন্দেহে সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ঘোষিত ‘দুর্নীতির ধারণাসূচক’ বা ‘করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স’ বাংলাদেশের জন্য সুসংবাদ বয়ে এনেছে। গত ১৭ নভেম্বর ঘোষিত সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থানে উন্নতি ঘটেছে_ সরকারি খাতের দুর্নীতি কিছুটা কমেছে। সূচকের ০-১০-এর স্কেলে বাংলাদেশ ২ দশমিক ৪ স্কোর পেয়ে ১৮০টি দেশের তালিকার নিম্নক্রম অনুযায়ী ত্রয়োদশ স্থানে উঠেছে। গত বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২ দশমিক ১ এবং অবস্থান দশম। অর্থাৎ ১৮০টি দেশের মধ্যে গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭তম থেকে ১৩৯তম স্থানে উন্নীত হয়েছে। এ সুসংবাদ নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার কতটুকু সন্তুষ্ট থাকতে পারে?
সন্তুষ্টি নির্ভর করবে ‘দুর্নীতির ধারণাসূচক’ প্রণয়নের ভিত্তি সম্পর্কে ধারণার সুস্পষ্টতার ওপর। আরও অনেকটা নির্ভর করবে অন্যদের, বিশেষত প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের অবস্থানের ওপর। দুর্নীতির সূচকটি প্রণীত হয় ১৩টি জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে, যদিও সব দেশের জন্য সব জরিপ প্রযোজ্য নয়। বাংলাদেশের এ বছরের সূচক ২০০৮ ও ২০০৯-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাতটি জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত। অর্থাৎ সুসংবাদের সবটুকু কৃতিত্ব বর্তমান সরকারের নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধূরীর নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন কমিশনের পুনর্গঠন, কমিশনকে সক্রিয়করণ এবং কমিশনের ব্যাপক দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সুফলও এতে প্রতিফলিত হয়েছে। তবুও এটি অবশ্যই ইতিবাচক সংবাদ এবং একে কাজে লাগিয়েই ভবিষ্যতে আরও সুসংবাদ সৃষ্টি করতে জাতি হিসেবে আমাদের বদ্ধপরিকর ও অনমনীয় হতে হবে।
প্রতিবেশীদের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়? দুর্ভাগ্যবশত নেপাল ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের স্কোর বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। যেমন_ ভারতের স্কোর ৩ দশমিক ৪, মালদ্বীপের ২ দশমিক ৫, ভুটানের ৫ দশমিক শূন্য, শ্রীলংকার ৩ দশমিক ১ এবং নেপালের ২ দশমিক ৩। পাকিস্তান আর বাংলাদেশের স্কোর একই (২ দশমিক ৪)। অর্থাৎ সব প্রতিবেশীর তুলনায় আমরা ভালো করছি না।
তবে বাংলাদেশ থেকে খারাপ অবস্থায় রয়েছে সোমালিয়া (প্রথম), আফগানিস্তান (দ্বিতীয়), মিয়ানমার (তৃতীয়), ইরাক ও সুদান (চতুর্থ), চ্যাড (পঞ্চম)। দুর্ভাগ্যবশত এ পাঁচটি দেশই ১২টি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে প্রণীত আমেরিকান ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে (জুলাই-আগস্ট ২০০৯ সংখ্যা) প্রকাশিত ২০টি অকার্যকর বা ‘ফেইলড স্টেটে’র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত অন্য সবগুলো দেশের স্কোরও বাংলাদেশের সমান বা তার কাছাকাছি। আর যেসব দেশের স্কোর ৩-এর কম, ধরে নেওয়া হয় যে, সেসব দেশে দুর্নীতি ব্যাপক ও ভয়াবহ। অর্থাৎ ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত বলে পরিচিত দেশগুলোই এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। অন্যভাবে বলতে গেলে, সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোই সর্বাধিক সংকটাপন্ন ও তাদের রাষ্ট্র-কাঠামো ভঙ্গুরপ্রায়। তাদের সরকার জনস্বার্থে পরিচালিত হয় না এবং তারাই অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। চরম বেদনাদায়ক হলেও এ কথা সত্য, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশও ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনের তালিকার ১৯ নম্বরে রয়েছে, যা আমাদের জন্য একটি হুশিয়ারি বাণী।
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার বড় কারণ হলো, দুর্নীতির সীমাহীন বিস্তার সে দেশেই সম্ভব, যেখানে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি হয় না এবং অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার একটি সংস্কৃতি বা ‘কালচার অব ইম্পিউনিটি’ সে সমাজে গড়ে ওঠে। যথেচ্ছারের এমন সংস্কৃতিতে সরকার দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণ করার একচ্ছত্র ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে আইনের শাসনের বিলুপ্তি ঘটে, সরকার আর নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, সমাজে বহু ক্ষমতাধর ব্যক্তির উদয় ঘটে এবং ক্ষমতার বহু কেন্দ্র সৃষ্টি হয়। সমাজে ‘জোর যার মুল্লুক তার’-এর পরিস্থিতি বিরাজ করে।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সরকারি খাতের সীমাহীন দুর্নীতি বেসরকারি খাতের দুর্নীতিকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করে। বস্তুত সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই বহুলাংশে বেসরকারি খাতের দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। সরকারের মদদ না থাকলে বেসরকারি খাতের দুর্নীতির হোতারা পার পেয়ে যেতে পারেন না এবং দুর্নীতিও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তার লাভ করতে পারে না। তাই একটি সৎ, দক্ষ, নিরপেক্ষ ও জনকল্যাণমুখী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা না গেলে বেসরকারি খাতের দুর্নীতিও রোধ করা যাবে না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ঘোষিত দুর্নীতির সূচক আমাদের বলে না দিলেও বাংলাদেশে দুর্নীতি যে ব্যাপক ও ভয়াবহ তা প্রতিনিয়তই অনুভব করা যায়। আর সাধারণ জনগণ, বিশেষত গ্রামে বসবাসকারী প্রত্যেকটি ব্যক্তি সাধারণত এর বেশি ভুক্তভোগী। দুর্নীতি তার বঞ্চনার ও দারিদ্র্যের সবচেয়ে বড় কারণ। ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর থেকেই সে অনুভব করতে থাকে দুর্নীতির আগ্রাসন। তার ঘরে বিদ্যুৎ নেই, সে তার জমিতে সেচ দিতে পারে না বিদ্যুতের অভাবে। সে যে সরকারি অফিসে যায়, হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়, এমনকি যে জরাজীর্ণ স্থাপনায় তার সন্তানকে স্কুলে পাঠায়, সবখানেই দুর্নীতির ব্যাপক উপস্থিতি। থানায় গেলে তাকে হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি খাজনা দিতে গেলেও তাকে ঘুষ দিতে হয়। বস্তুত প্রায় সবখানেই যেন সরকারের বেতনভুক্ত একদল ব্যক্তি, তার ট্যাক্সের পয়সা থেকে যাদের বেতন-ভাতা আসে, দুর্নীতির দোকান খুলে বসে আছে মক্কেলের অপেক্ষায়, তার মতো সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদে ভাগ বসানোর আশায়। ইউনিয়ন পর্যায়ের যেসব সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা তাকে বিভিন্ন সেবা দেওয়ার কথা, তারা তা দিতে আসে না, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তাদের খুঁজেও পাওয়া যায় না। ফলে দুর্নীতির কারণে সে প্রয়োজনীয় ও মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ইত্যাদি নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। সে যে ভাঙাচুরা গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে হাঁটাচলা করে সেখানেও দুর্নীতির চিহ্ন। অর্থাৎ দুর্নীতি যেন ছায়ার মতো সারাদিন তার সঙ্গী। দুর্নীতি অনেক ক্ষেত্রে তাকে তাড়া করে বেড়ায়, অনেকটা তার জীবনের গতিকে থামিয়ে দেয়, এমনকি তছনছ করে ফেলে। দুর্নীতির কারণে সরকারের উন্নতির জোয়ার তার জন্য যেন মরীচিকামাত্র।
বস্তুত দুর্নীতি উন্নয়নের গতিকে শল্গথ করে দেয় এবং সাধারণ মানুষকে উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত করে। এ অভিজ্ঞতা সব দেশেরই। তাই ‘ডোন্ট লেট করাপশন কিল ডেভেলপমেন্ট’ (দুর্নীতিকে উন্নয়ন ব্যাহত করতে দিও না) ছিল ৯ ডিসেম্বর পালিত ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দিবসে’র এবারকার প্রতিপাদ্য। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন তার বাণীতে বলেন, `When public money is stolen for private gain, it means fewer resources to build schools, hospitals, roads and water treatment facilities. When foreign aid is diverted into private bank accounts, major infrastructure projects come to a halt. Corruption enables fake or substandard medicines to be dumped on the market, and hazardous waste to be dumped in landfill sites and in oceans. The vulnerable suffer first and worst. (সরকারি অর্থ ব্যক্তিস্বার্থে চুরি করা হলে স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তা ও পানি শোধনাগার তৈরির জন্য কম সম্পদ পাওয়া যায়। যখন বৈদেশিক সাহায্য ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়, তখন গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো তৈরির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। দুর্নীতির ফলে নিম্নমানের ওষুধ বাজারে ছাড়া হয়, ক্ষতিকর বর্জ্য ভূমি ভরাটে ও সমুদ্রে ফেলা হয়। ঝুঁকিতে বসবাসকারীরাই দুর্নীতির প্রথম ও সর্বাধিক ভুক্তভোগী)।
উন্নয়ন চেষ্টাকে ব্যাহত করা ছাড়াও দুর্নীতির আরও ভয়াবহ দিক রয়েছে। ফলে সমাজ সংকটে নিপতিত হতে পারে। এ সম্পর্কে মহাসচিব বলেন, `Development is not the only casualty. Corruption steals elections. It undermines the rule of law. And it can jeopardize security. As we have seen over the last year, it can also have a serious impact on the international financial system.(উন্নয়নই শুধু বাধাগ্রস্ত হয় না। নির্বাচনও দুর্নীতির শিকার হতে পারে। ফলে নিরাপত্তা বিঘি্নত হতে পারে। আমরা বিগত বছরে যেমন লক্ষ্য করেছি, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপরও এর বিরূপ প্রভাব দারুণভাবে পড়তে পারে)। অর্থাৎ দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে দুর্যোগ ও যথেচ্ছাচারের জন্ম হতে এবং আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে আবারও লাইনচ্যুত করে ফেলতে পারে।
তাই দুর্নীতির ভয়াবহ পরিণতি থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে সরকারকে পরিপূর্ণ আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের দোদুল্যমানতা অনেকের মনেই আশঙ্কার সৃষ্টি করে। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে বারবার কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন; কিন্তু বাস্তবে কারও বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এ পর্যন্ত কোনো দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নজির সৃষ্টি হয়নি। বরং অনেক চিহ্নিত দুর্নীতিবাজকে, যাদের দুর্নীতি সম্পর্কে ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে দেখা যায়। অনেককে মনোনয়ন দিয়ে এমপিও করা হয়েছে। এ অবস্থা কোনোভাবেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের দৃঢ়প্রত্যয়ের প্রতিফলন নয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের পুনর্গঠনও দুর্নীতি নির্মূলের ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। আরও প্রশ্নের উদ্রেক করছে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইন পরিবর্তন সম্পর্কে অনেক কথাবার্তা। দুর্নীতি দমন কমিশন ভবিষ্যতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে কি-না এ ব্যাপারে অনেকেই আজ সন্দিহান। সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে কমিশনের সদস্যদের হয়রানি করার চেষ্টাও এ ব্যাপারে সন্দেহের উদ্রেক না করে পারে না।
সরকারি দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পৃষ্ঠপোষকতায় সারাদেশে যে দখলদারিত্ব চলছে তাও অনেককে শঙ্কিত করছে। সরকারি দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সদস্যদের চাঁদাবাজি এবং টেন্ডারবাজিও সরকারের আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সরকারের আন্তরিকতা আরও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত নীতিমালায় সাম্প্রতিক পরিবর্তনের কারণে।
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি আমাদের অনেক দিনের সমস্যা। গত সরকারের আমলে যা সীমাহীন পর্যায়ে পেঁৗছেছিল। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সব ক্ষমতাধর ব্যক্তির সম্পদের হিসাব প্রকাশের অঙ্গীকার করেছিল, যা ছিল একটি আশার বাণী। আমরা বিশেষভাবে উৎসাহিত বোধ করেছিলাম যে, ক্ষমতা গ্রহণের পরপর আমাদের অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন সব সংসদ সদস্যের সম্পদের হিসাব নেওয়া এবং প্রকাশ করা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে আমরা কিছুই পাইনি। আমাদের একজন সংসদ সদস্য, সাবের হোসেন চৌধুরী, সংসদ সদস্যদের জন্য একটি আচরণবিধি গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছেন, যার মাধ্যমে তাদের স্বার্থের দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রগুলো জনসমক্ষে প্রকাশিত হবে। ভারতীয় লোকসভা কিছুদিন আগে এমনই একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করেছে। অনেক দেশেই এ ধরনের বিধান বিদ্যমান। আমরা আশা করেছিলাম, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ার অঙ্গীকারের ভিত্তিতে ক্ষমতায় আসা বর্তমান সরকার দ্রুততার সঙ্গে এ ধরনের উদ্যোগ গ্র্রহণ করবে।
এ প্রসঙ্গে বর্তমান সংসদের একটি সিদ্ধান্ত আমাদের বিশেষভাবে হতাশ করেছে। ক্ষমতা গ্রহণের পর বর্তমান সংসদ প্রবল উৎসাহের সঙ্গে সাবেক স্পিকার, ডিপুটি স্পিকার ও চিফ হুইপের দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছিল এবং সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি ঘোষণা দিয়েছিল যে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে তাদের রেহাই দেওয়া হবে না। এমনকি কমিটি সাবেক স্পিকারকে সংসদ থেকে বহিষ্কারের কথাও বলেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণাদি সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারকে সংসদ থেকে বহিষ্কারে সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেননের প্রস্তাব সংসদ প্রত্যাখ্যান করে। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের শাস্তি হতো অতি কঠোর। দুর্ভাগ্যবশত এটিই বাংলাদেশের ‘কালচার অব ইমিউনিটি’_ বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা গুরুতর অপরাধ করে পার পেয়ে যান, তাদের শাস্তি হয় না। কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়, যেমনিভাবে আমাদের সংসদ এড়িয়ে গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের তদন্ত শেষ করে আদালতে বিষয়টি প্রেরণ করবে এবং আদালতে বিষয়টি কত বছর ঝুলে থাকবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না_ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিজ্ঞ কেঁৗসুলিরা বিষয়টিকে হিমাগারেও পাঠিয়ে দিতে পারেন। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, এভাবে চলতে থাকলে দুর্নীতি কোনোদিন আমাদের দেশ থেকে নির্মূল হবে না। প্রসঙ্গত, ভারতীয় সংসদ ২০০৬ সালে নানা অসদাচরণের অভিযোগে একইসঙ্গে ১১ জন সদস্যকে বহিষ্কার করেছিল।
পরিশেষে, সত্যিকারার্থেই বাংলাদেশকে সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কবল থেকে মুক্ত করতে হলে আমাদের একটি সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। কঠোরতা ও নিরপেক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে সরকারকে তার রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রদর্শন করতে হবে। দলমত নির্বিশেষে কিছু চিহ্নিত দুর্নীতিবাজকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসনে সততা, নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের লক্ষ্যে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে এবং তথ্য কমিশনকে সক্রিয় করতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইনের বিধানানুযায়ী রাজনৈতিক দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন থাকা বেআইনি এবং এগুলোকে অবিলম্বে বিলুপ্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সংসদ সদস্যদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করে তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। একইসঙ্গে সংসদ সদস্যসহ সব ক্ষমতাধর ব্যক্তির বাৎসরিকভাবে সম্পদের হিসাব দিতে এবং তা প্রকাশ করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ আইনে অন্তর্ভুক্ত ‘ওয়ার্ড সভা’কে কার্যকর করে তৃণমূল থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদের চেষ্টা শুরু করতে হবে। নাগরিক সমাজকেও দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
মনে রাখা প্রয়োজন, দুর্নীতি নির্মূলের অঙ্গীকারই যথেষ্ট নয়, সরকারকে এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। মহাসচিব তার বাণীতে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন : `A new mechanism decided on at the recent Conference of States Parties in Doha means that, from now on, states will be judged by the actions they take to fight corruption, not just the promises they make.’(সম্প্রতি দোহায় অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের সভায় একটি নতুন প্রক্রিয়া বিষয়ক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রগুলোকে মূল্যায়ন করা হবে দুর্নীতি নির্মূলে তাদের প্রতিশ্রুতি নয়, পদক্ষেপের ভিত্তিতে)। কারণ পদক্ষেপের স্বর প্রতিশ্রুতি থেকে অনেক বেশি জোরালো।
– ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক, সুজন-
সুশাসনের জন্য নাগরিক

সূত্র: দৈনিক সমকাল, ১৭ ডিসেম্বর ০৯

Related Post

জনগণেরই পায়ের তলায় মাটি নেই!জনগণেরই পায়ের তলায় মাটি নেই!

বদিউল আলম মজুমদার | আপডেট: ০০:০৭, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪ সাম্প্রতিক কালে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।

এ যেন ছিল একটি গণভোটএ যেন ছিল একটি গণভোট

ড. বদিউল আলম মজুমদার গত ০৬ জুলাই অনুষ্ঠিত হলো বহু প্রতীক্ষিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। বিপুল উত্সাহ, উত্কণ্ঠা আর দুই প্রধান জোটের পারস্পরিক দোষা-রোপের মধ্য দিয়ে নির্বাচনটি সম্পন্ন হয়েছে। মূলত

চাই শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনচাই শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন

বদিউল আলম মজুমদার ২০১০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সময় থেকেই ক্ষমতাসীন দল সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও সক্ষম করার কথা বলে আসছে। গত সোয়া তিন বছরে