সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক সংবাদ সম্মেলন ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ২০১৬: রক্তক্ষয়ের রেকর্ড’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ২০১৬: রক্তক্ষয়ের রেকর্ড’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

Picture‘ব্যাপক সহিংসতাসহ বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনী অনিয়মের কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সবচেয়ে মন্দ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন’ বলে মন্তব্য করেছেন সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর নেতৃবৃন্দ। আজ ২৬ মে ২০১৬ সকাল ১১.০০টায়, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সুজন আয়োজিত ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ২০১৬: রক্ষক্ষয়ের রেকর্ড’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সুজন নেতৃবৃন্দ এ মন্তব্য করেন। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত নির্বাচনপূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন পরবর্তী সংঘর্ষ এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক বিরোধের জেরে ১০১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে এবং আহতের সংখ্যা অন্তত আট হাজার ছাড়িয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুজন সহ-সম্পাদক জনাব জাকির হোসেন, নির্বাহী কমিটির সদস্য জনাব সৈয়দ আবুল মকসুদ ও প্রকৌশলী মুসবাহ আলীম এবং সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।


লিখিত বক্তব্যে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ২২ মার্চ থেকে শুরু হয়ে এখনও চলমান রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ২০১৬। ইতোমধ্যেই চারটি ধাপের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ২৮ মে ও ৪ জুন ২০১৬ তারিখে যথাক্রমে পঞ্চম ও ষষ্ঠ ধাপের ভোটপর্বের মধ্য দিয়ে এই নির্বাচনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। সহিংসতাসহ বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনী অনিয়ম ও নেতিবাচক অনুষঙ্গের দৃশ্যমানতার কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিকেই সবচেয়ে মন্দ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বলে মনে করেন অনেকে। কেননা ব্যাপক রক্তক্ষয় ও অনিয়মের দিক থেকে অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে এই নির্বাচন। নির্বাচনী সহিংসতায় হতাহতের বিষয়টি এতই ব্যাপক যে, ইতোমধ্যেই তা সকল সচেতন মানুষের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।’

নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণহানি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অতীতের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলোর প্রাণহানির তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, ১৯৭৩, ১৯৭৭, ১৯৮৩ ও ১৯৯২-এ প্রাণহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি। ১৯৮৮ সালে ৮০ জন, ১৯৯৭ সালে ৩১ জন, ২০০৩ সালে ২৩ জন এবং ২০১১ সালে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানা যায় (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ এপ্রিল ২০১৬)। অতীতের নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে ১৯৮৮ সালে। সবচেয়ে খারাপ নির্বাচনের তকমাও জুটেছিল ঐ নির্বাচনের নামের পাশে। প্রাণহানির ক্ষেত্রে অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এবং তা চলছে দীর্ঘমেয়াদিভাবে।’

দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ‘আমরা মনে করি যে, প্রতিযোগিতার মনোভাব থেকে গ্রহণ না করে যে কোনো মূল্যেই জয়ী হওয়ার আকাক্সক্ষাই নির্বাচনী সহিংসতার বড় কারণ। আর নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেও পার পাওয়া গেলে সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াটাই স্বাভাবিক। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, নিহত সর্বমোট ১০১ জনের মধ্যে চেয়ারম্যান পদের নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ঘটনা বা বিরোধেই প্রাণ গিয়েছে ৬৩ জনের। পাশাপাশি এই নির্বাচনে আচরণবিধি ভঙ্গের বিরুদ্ধে কখনই নির্বাচন কমিশনকে আমরা কঠোর অবস্থানে দেখিনি। এটাও সহিংসতায় বৃদ্ধির বড় কারণ।’

তিনি বলেন, ‘বিভাগভিত্তিক প্রাণহানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ঢাকা বিভাগে ২২ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯ জন, বরিশাল বিভাগে ১৬ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৬ জন, খুলনা বিভাগে ১৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৯ জন, রংপুর বিভাগে ৫ জন এবং সিলেট বিভাগে ১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। দলগত পরিচয়ের দিক থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী বা সমর্থক ৪০ জন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী বা সমর্থক ১২ জন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ২ জন, জাতীয় পার্টি-জেপি’র ১ জন, জনসংহতি সমিতির ১ জন, স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী বা সমর্থক ২ জন, মেম্বার প্রার্থীর কর্মী বা সমর্থক ৩১ জন এবং ১২ জন সাধারণ মানুষ রয়েছেন প্রাণহানির তালিকায়। মৃতদের মধ্যে ৪ জন নারী ও ৩ জন শিশুসহ একজন সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থী ও ৩ জন মেম্বার প্রার্থীও রয়েছেন। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে ৪২টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৪৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ পর্যন্ত নিহত ১০১ জনের মধ্যে নির্বাচন-পূর্ব সংঘর্ষে ৪৫ জন, নির্বাচনকালীন সংঘর্ষে ৩৬ জন এবং নির্বাচনোত্তর সংঘর্ষে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।’’

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া সম্পর্কে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ‘চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার অতীতের যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সে অনুযায়ী ১৯৮৮ সালে ১০০ জন,  ১৯৯২ সালে ৪ জন, ১৯৯৭ সালে ৩৭ জন এবং ২০০৩ সালে ৩৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রেও ১০০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের নিয়ে ১৯৮৮ সাল ছিল এগিয়ে। তবে অতীতের সকল রেকর্ড ম্লান হয়ে গিয়েছে এবারের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের সংখ্যার কাছে। নবম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এই সংখ্যা ২১১। প্রথম ধাপে ৫৪ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৩৪ জন, তৃতীয় ধাপে ২৯ জন, চতুর্থ ধাপে ৩৪ জন, পঞ্চম ধাপে ৪২ জন এবং ষষ্ঠ ধাপে এ পর্যন্ত ১৮ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। এরা সকলেই ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী।’

নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থার ফলে নির্বাচনী আইনানুযায়ী এখন চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে। আর এই মনোনয়ন দিতে গিয়েই ঘটছে বাণিজ্যের ঘটনা। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলসমূহের মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রবণতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে যে, প্রতিদিনই তা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে। মনোনয়ন বাণিজ্যের ঘটনা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলে ঘটার অভিযোগ পাওয়া গেলেও, আওয়ামী লীগে এর ব্যাপকতা বেশি।’

মনোনয়ন প্রদানে নারীদের উপেক্ষা সম্পর্কে তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কথা বলে আসলেও বাস্তবে আমরা উল্টো চিত্রটি দেখতে পাই। এ পর্যন্ত চার ধাপে ১৭ জন নারী নির্বাচিত হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। প্রথম ধাপে ৮ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৪ জন, তৃতীয় ধাপে ২জন এবং চতুর্থ ধাপে ৩ জন নারী নির্বাচিত হয়েছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি ধাপের নির্বাচনের পূর্বেই প্রতিপক্ষের এজেন্টদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া বা ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া; বুথ দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ভরা; চেয়ারম্যান প্রার্থীর ব্যালটে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা; নির্বাচনী কর্মকর্তা কর্তৃক ব্যালট পেপারে সিল মারা বা সিল মারতে সহায়তা করা; ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছে। কোনো কোনো এলাকায় ভোট প্রদানে এমন অস্বাভাবিকতা ছিল যে, ভোট প্রদানের তালিকায় মৃত ব্যক্তি ও প্রবাসীরাও ছিলেন। কোথাও কোথাও ভোট পড়ার হার ছিল ১০০ শতাংশেরও অধিক। কোনো কোনো ইউনিয়নে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।’

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘চলমান ইউপি নির্বাচন নির্বাচনও নয় এবং গণতন্ত্রও নয়। বরং এক দুঃস্বপ্ন। নির্বাচনে অনিয়ম, মনোনয়ন বাণিজ্য, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের সংখ্যা প্রভৃতি বিবেচনায় এ নির্বাচন যেন সকলের কাছে গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। তারমানে এগুলো এখন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যত গণতন্ত্রের জন্য কাক্সিক্ষত নয়।’ তিনি আরও বলেন যে, ‘যারা চোখে দেখে না বা কানে শুনে না তারা ছাড়া সকলেই বলবেন যে, এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহ কোনোক্রমেই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ছিলো না।’

সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য এতটাই প্রকট ছিলো যা অনেকটা রোযার আগে ছোলা কেনা-বেচার মত করে বেচা-কেনা হয়েছে। নিবাচনে অনিয়ম কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কোথাও কোথাও মৃত ব্যক্তিরাও ভোট দিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনে নিহতরা আসলে নিহত নন, তারা শহীদ হয়েছেন। তাই এ নির্বাচনকে একটি শহিদী নির্বাচন বলে আখ্যা দেয়া দেয়া যায়। এই নির্বাচন কমিশন অন্তত আর কিছু করতে পারুক বা না পারুক যারা মারা গিয়েছেন তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করতে পারেন। যদিও এতগুলো মানুষ মারা যাওয়া কোনো খেলা কিংবা তামাশার বিষয় নয়।’

মূল প্রবন্ধ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

Related Post

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার মিথ্যাচারের প্রতিবাদে সুজন-এর সংবাদ সম্মেলনপ্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার মিথ্যাচারের প্রতিবাদে সুজন-এর সংবাদ সম্মেলন

সুজন স¤পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার স¤পর্কে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার মিথ্যাচারের প্রতিবাদে সুজন-এর পক্ষ থেকে আজ ২৯ জানুয়ারি ২০২২, শনিবার, সকাল ১১:৩০টায়, অনলাইনে এক সংবাদ সম্মেলন

‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেমন জনপ্রতিনিধি পেলাম’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেমন জনপ্রতিনিধি পেলাম’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

খুলনা মডেলে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা ছিল ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন’ বলে মন্তব্য করেছেন ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর নেতৃবৃন্দ। তারা আজ ‘সুজন’-এর পক্ষ থেকে ‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেমন জনপ্রতিনিধি

‘সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ত থাকার কোনো সুযোগ নেই’‘সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ত থাকার কোনো সুযোগ নেই’

‘সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের মূল নির্বাচন কমিশনের। তাই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি যে কোনো ধরনের অনিয়মের ঘটনা রোধে নির্লিপ্ত না থেকে কমিশনকে কঠোর ভূমিকা পালনের আহবান জানিয়েছেন