রাজনীতিকদের টনক নড়বে কবে?

prothom-alo-logo_v4
বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ১০-০৩-২০১৩
দেশের চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা দুই নেত্রীকেও আলোচনায় বসাতে চায় (যুগান্তর, ৭ মার্চ, ২০১৩)। সরকার ও বিরোধী দল আলোচনার মাধ্যমে বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধান করবে, এমন আকাঙ্ক্ষা অনেক নাগরিকই পোষণ করেন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মূলত এভাবেই সমস্যার সমাধান হয়ে থাকে। এটিই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। বস্তুত, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছা এবং নাগরিকদের মধ্যে মতৈক্য সৃষ্টি করাই রাজনীতির উদ্দেশ্য।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার বিরোধ মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করার প্রেক্ষাপটে নির্বাচনকালীন কী ধরনের সরকার থাকবে, এটাই এখনকার বিরোধের মূল ইস্যু। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এবং নবম সংসদের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আপাতত বদ্ধপরিকর। পক্ষান্তরে বিএনপি ও তার মিত্ররা ইতিমধ্যেই সে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে, ফলে এক চরম অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। এফবিসিসিআইয়ের মধ্যস্থতায় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ অচলাবস্থা দূর করা কি সম্ভব?
আমাদের আশঙ্কা, সংলাপের মাধ্যমে এই অচলাবস্থা দূর করার জন্য দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোনো প্রণোদনা নেই। বরং বর্তমান অচলাবস্থা নিরসন না করাই তাদের অবস্থান থেকে যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। প্রণোদনা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কোনো কাজের মাধ্যমে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে যুক্তিবান মানুষ তা করতে প্রণোদিত হয়।
সংলাপ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ মুহূর্তে সমাধানে পৌঁছার ব্যাপারে আমাদের আশাবাদী না হওয়ার কারণ অনেক। প্রথমে ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যাক। উভয় দলের অনড় অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতে হলে সরকারকে ছাড় দিতে হবে। নির্বাচনকালীন সময়ে একধরনের নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সম্মত হতে এবং নির্বাচনের আগে সংসদ বাতিল করতে হবে। তা না হলে সবার জন্য সমতল ক্ষেত্র তৈরি হবে না এবং বিরোধী দলও নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হবে না। বিরোধী দলসহ অনেকেই মনে করেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবি হবে। ভরাডুবি না হলেও, তারা যে নির্বাচনে জিতবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ, বিরাট জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এলেও গত চার বছরে মহাজোট সরকার জনগণের হূদয়-মন জয় করতে পারেনি। গত বছরের এক জনমত জরিপে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ-বিএনপির জনপ্রিয়তা প্রায় সমান সমান। সম্প্রতি প্রথম আলো (৪ মার্চ ২০১৩) পরিচালিত অনলাইন জরিপে ১১ হাজার ছয়জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ‘জামায়াতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিএনপি ভবিষ্যতে লাভবান হবে বলে মনে করেন কি?’ এ প্রশ্নের উত্তরে ৫০ দশমিক ০১ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ এবং ৪৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ ‘না’ উত্তর দেন। প্রসঙ্গত, সংবাদপত্রের অনলাইন জরিপে অংশগ্রহণকারীরা সাধারণত তরুণ ও শিক্ষিত। ফলে নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে মহাজোটের হেরে যাওয়ার আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু কোনো দলই নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চায় না। কারণ, নির্বাচনে হারলে পরাজিতদের চরম ‘মূল্য’ দিতে হয়।
মূল্যটা হয় দুই ধরনের। স্বচ্ছতা-জবাবদিহি-বিবর্জিত শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া মানে পাঁচ বছরের জন্য ব্যক্তিতন্ত্র, দলতন্ত্র, ফায়দাতন্ত্র তথা লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ইজারা’ পাওয়া। নির্বাচনে পরাজিত দল এ ধরনের অন্যায় ও অবৈধ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। এটি হলো অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, ‘অপরচুনিটি কস্ট’ বা সুযোগ হারানোর মূল্য। যেহেতু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো আদর্শভিত্তিক নয়, যেহেতু তারা আচরণ করে ফায়দা বিতরণের মাধ্যমে অনেকটা সিন্ডিকেটের মতো, তাই ইজারাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলে তাদের নিজেকে সক্রিয় ও সচল রাখা দুরূহ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া নির্বাচনে পরাজিত হলে পরবর্তী পাঁচ বছরে বহু ধরনের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও মামলা-হামলার অপসংস্কৃতি বিশেষভাবে গত এক দশকে ব্যাপকভাবে বেড়েছে, দিন দিন তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ২০০৪ সালে বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার জীবনের ওপর হামলা, শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা এবং বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলা দায়ের করা যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এ ধরনের চরম, এমনকি প্রাণের বিনিময়ে মূল্য প্রদান নিঃসন্দেহে ক্ষমতাসীনদের যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে জিততে বদ্ধপরিকর করাই স্বাভাবিক।
আরেকটি কারণেও রাজনৈতিক দল ছলে-বলে-কলে-কৌশলে জাতীয় নির্বাচনে জিততে চায়। নির্বাচনে জয়ী হলে অতীতের সব মামলা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে দায়ের করার অজুহাতে প্রত্যাহার করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। যেমন, গত চারদলীয় সরকার তাদের মেয়াদকালে নিজেদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। বর্তমান সরকারও একই কাজ করেছে, এমনকি খুনের মামলাও প্রত্যাহার করেছে। মূলত এসব কারণেই রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের তথাকথিত ‘ক্ষমতার রাজনীতিতে’ আবদ্ধ রাখে।
এবার বিরোধী দলের অবস্থান থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যাক। বিরোধী দল, এমনকি অধিকাংশ নাগরিকও মনে করেন যে নির্বাচনকালীন একটি দলনিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় না থাকলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না, ফলে ক্ষমতাসীনরাই আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে। প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক জনমত জরিপ অনুযায়ী, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের খাতিরে দেশের অন্তত তিন-চতুর্থাংশ জনগণ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। কিন্তু সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতে হলে বিএনপিকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি থেকে সরে আসতে হবে। তাদের হয়তো একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ফর্মুলায় রাজি হতে হবে। এ ধরনের সমঝোতা হলে বিএনপি ও তার মিত্ররা যে আগামী নির্বাচনে জয়ী হবে, তা নিশ্চিত নয়। পরাজিত হলে তারা আরও পাঁচ বছরের জন্য লুটপাটের ইজারা প্রতিষ্ঠার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে; তাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চলতেই থাকবে; চলমান মামলাগুলোতে তাদের শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে; তাদের ওপর নতুন করে মামলা-হামলাও হবে। ফলে ভবিষ্যতে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। তাই বিরোধী দলও যেকোনো মূল্যে পরবর্তী নির্বাচনে জিততে বদ্ধপরিকর হওয়াই স্বাভাবিক। এমতাবস্থায় বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও সমঝোতায় পৌঁছার আগ্রহ না থাকারই কথা।
এটা সুস্পষ্ট যে সরকারি দল ও বিরোধী দল, কোনো পক্ষেরই পরবর্তী নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছার আগ্রহ নেই। তারা বল প্রয়োগের মাধ্যমেই সমাধান চায়। তাই এ মুহূর্তে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। তবে উভয় দলের মধ্যে কোনোভাবে যদি এমন ধারণা সৃষ্টি হয় যে, প্রত্যেকেই পরবর্তী নির্বাচনে জিতবে, তাহলেই তারা দ্রুত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার উদ্দেশ্যে যথাশিগগির নির্বাচন অনুষ্ঠান করার লক্ষ্যে আলোচনায় বসতে পারে। এমনি পরিস্থিতিতে যেনতেন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানই মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াবে। ফলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধান করার লক্ষ্যে নির্বাচন-প্রক্রিয়া ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যে গভীর সংস্কার দরকার, তা উপেক্ষিতই থেকে যাবে। ফলে নির্বাচন হলেও আমাদের গণতন্ত্র অস্থিতিশীলই থেকে যাবে।
আশাবাদী না হতে পারলেও আমরা এফবিসিসিআইয়ের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। আশা করি, অন্য নাগরিকেরাও সমঝোতার মাধ্যমে বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের দাবিতে সোচ্চার হবেন। অধিকাংশ নাগরিকের মুখে এ দাবি উচ্চারিত হলেই রাজনীতিবিদদের টনক নড়বে এবং তাঁরা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবেন। আর রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতেই হবে। কারণ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হলে, আজ হোক আর কাল হোক, এ সমস্যার সমাধান করতেই হবে, যদিও আমরা জানি না কী প্রক্রিয়ায়, কত সময়ে তা হবে। তাই রাজনীতিবিদেরা প্রজ্ঞা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন, যদি তাঁরা সংলাপের মাধ্যমে তথা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সমস্যা সমাধানের জন্য এখনই এগিয়ে আসেন। সম্ভাব্য মতৈক্যের বিষয়গুলো চিহ্নিত করে একটি ‘নাগরিক সনদ’ তৈরির মাধ্যমে, যাতে নির্বাচনী ব্যবস্থার ও শাসন-প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো সূদূরপ্রসারী সংস্কারের বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে, এফবিসিসিআই এ কাজে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিতে পারে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
সূত্র: প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০১৩

Related Post

নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে সংশয়নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে সংশয়

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ২৩-১১-২০১২ ১১ নভেম্বর ২০১২ তারিখের প্রথম আলোয় প্রকাশিত দুটি সংবাদের শিরোনাম আমাদের মনে দারুণ সংশয়ের সৃষ্টি করেছে। শিরোনাম দুটি হলো: ‘সব মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব চাওয়া হবে:

সংকট উত্তরণে প্রয়োজন নাগরিক ঐক্যসংকট উত্তরণে প্রয়োজন নাগরিক ঐক্য

ড. ব দি উ ল আ ল ম ম জু ম দা র আগামী আট-নয় মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রথম আবশ্যকীয় পদক্ষেপ অবাধ, নিরপেক্ষ

নারী উন্নয়ন নীতি-বিরোধিতাকারীদের আসল উদ্দেশ্য কীনারী উন্নয়ন নীতি-বিরোধিতাকারীদের আসল উদ্দেশ্য কী

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ০৯-০৫-২০১১ সরকার ঘোষিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে সারা দেশে একটি চরম অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। নারীনীতিকে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী দাবি করে একটি বিশেষ