সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক গোলটেবিল বৈঠক সংস্কারের হালচাল শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত

সংস্কারের হালচাল শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত

গত ১৫ মে, ২০০৮ সকাল ১০টায় সিরডাপ মিলনায়তনে ‘সংস্কারের হালচাল’ শীর্ষক এক বিশেষ গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিকের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই গোলটেবিল আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন ‘সুজন’ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদ। বিশিষ্ট গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ-এর সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ‘সুজন’ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদ বলেন, প্রকৃত রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দিকে যাবার জন্য রাজনৈতিক দলে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ও পদ্ধতিতে এবং কমিশনের সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি সুজনের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে বলেন, সুশাসনের জন্য আমরা জনগণকে সাথে নিয়ে কাজ করি। তিনি বলেন, আমরা মনে করি না সংস্কারের কাজ এই নির্বাচনের সাথেই শেষ হয়ে যাবে। নাগরিক সমাজের বিশেষ গুরুত্বের কথা তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, আমরা রাজনীতিবিদদের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ দেখতে চাই।
মূল প্রবন্ধে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং রাজনীতিকে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের কবল থেকে মুক্ত করে সুস্থ ধারা আনয়নের লক্ষ্যে বাম রাজনৈতিক দলগুলো এবং ‘সুজন’ বহুদিন থেকেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলের সংস্কার এবং নির্বাচনে প্রার্থীদের তথ্য প্রদানের দাবি করে আসছে। এ ব্যাপারে একটি জনমতও সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত ‘গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ২০০৮’ আইনে পরিণত করার মাধ্যমে তা বাস্তবে রূপ লাভ করবে। তবে আমরা মনে করি যে, নির্বাচনী ব্যয় হ্রাস, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার সাথে সাথে প্রার্থীদের থেকে তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত খসড়ায় পরিবর্তন আনা আবশ্যক। একইসাথে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংগৃহীত তথ্যের যথাযথ নিরীক্ষার ভিত্তিতে মিথ্যা তথ্য প্রদানকারী এবং তথ্য গোপনকারীর বিরূদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিধানের যথাযথ প্রয়োগও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজনৈতিক দলের স্ব উদ্যোগে নিজেদের সংস্কার এবং কালো-টাকা, পেশীশক্তির মালিক তথা দুর্বৃত্তদের মনোনয়ন প্রদান থেকে বিরত না থাকলে কোন পরিবর্তনই অর্জিত হবে না। ‘সুজন’-এর পক্ষ থেকে উত্থাপিত প্রবন্ধে বিশেষভাবে যে সকল বিষয়সমূহ নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবে অন্-র্ভুক্ত হওয়া প্রয়োজন বলে দাবি জানানো হয় সেগুলো মধ্যে অন্যতমগুলো হল: রিটার্নিং অফিসারগণ কর্তৃক হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যাদির আসনভিত্তিক সার-সংক্ষেপ তৈরি করে জনগণের অবগতির জন্য গণমাধ্যমে বিতরণের ব্যবস্থা করা; সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার যে কোন প্রার্থী বা ভোটার যে কোন প্রার্থীর দাখিলকৃত হলফনামার বিরুদ্ধে পাল্টা হলফনামা (counter affidavit) দাখিলের বিধান রাখা এবং গণমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করা; মনোনয়নপত্র জমাদানকালে কোন প্রার্থী কিংবা তার পক্ষে পাঁচ জন ব্যক্তির বেশি উপস্থিত না থাকা এবং কোন মিছিল বা শোডাউনের আয়োজন না করার বিধান রাখা; ঋণ খেলাপীর ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পূর্ববর্তী ছয় মাসের পরিবর্তে এক বছরের বিধান রাখা। এক্ষেত্রে এক বছর পূর্বে ঋণ পুনর্তফসিলিকরণও অযোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা; ব্যালট পেপারে দলীয় প্রতীকের পাশাপাশি প্রার্থীর ছবি প্রদান অন্-র্ভুক্ত রাখা; নির্বাচনী ব্যয় হ্রাসের জন্য নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে যথাসম্ভব সকল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর উপস্থিতিতে প্রতি ইউনিয়নে এবং পৌরসভার প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে প্রজেকশন মিটিং এর ব্যবস্থা করা; রির্টানিং অফিসার প্রার্থীগণ কর্তৃক হলফনামার মাধ্যমে দাখিলকৃত তথ্যের ভিত্তিতে কমন পোস্টার তৈরি করা, প্রার্থীগণ কর্তৃক জনসভা, মিটিং, মিছিল, শোডাউন, গেট বা তোরণ নির্মাণ ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা; দলের সকল আয়-ব্যয় ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পরিচালনা করা; প্রত্যেক রাজনৈতিক দল তার প্রাথমিক সদস্যদের একটি রেজিস্টার সংরক্ষণ এবং এই রেজিস্টার ন্যূনতমভাবে প্রতি বৎসর আপডেট করে দলীয় ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা; প্রতি তিন বৎসর পর পর নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহকে নিবন্ধন নবায়ন করা; কমিশনের নিকট অডিট রিপোর্ট দাখিল করা। এছাড়াও জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রার আলোকে ২০১৫ সালের মধ্যে দলীয় সকল কমিটিতে ৫০% নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা; নির্বাচনী আইনের গুরুতর লঙঘনজনিত কারণে প্রার্থীতা বাতিল, নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা স্থগিত/বাতিল ইত্যাদির জন্য সিনিয়র জেলা জজ বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে ছয়টি বিভাগে ছয়টি �ইলেকশনস মিসকণ্ডাক্টস এবং ডিসকোয়ালিফিকেশন� কমিটি গঠন করা।
জনাব সৈয়দ আবুল মকসুদ এই অবস্থাকে অস্বাভাবিক অবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রের জন্য, জনগণের জন্য ও দেশের ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের মাঝে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় আসা জরুরি। জনাব এম হাফিজউদ্দিন খান �সুজন�-এর প্রস্-াবসমূহের সাথে একমত পোষণ করে বলেন, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত কর্মকর্তা/কর্মচারিদের অসদাচারণ ও পক্ষপাতিত্বের দায়িত্বে অবহেলার জন্য শাস্-ি বিধানের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকা প্রয়োজন। জনাব এএসএম শাহাজাহান সনদ ও সংলাপের ফলপ্রসূ বাস্-বায়নের প্রশ্নে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, রাজনৈতিক সংস্কার অত্যন্- জরুরি। তাই এজন্য প্রয়োজনীয় স্টেপগুলো যথাযথভাবে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। জনাব আ.স.ম আব্দুর রব বলেন, সংস্কার ছাড়া গত ছত্রিশ বছরে যে অপরাজনীতি হয়েছে তা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে হওয়া উচিত বলে মন্-ব্য করে তিনি আরো বলেন, দীর্ঘমেয়াদিভিত্তিতে দুর্নীতি ও সংস্কারের এই ধারা অব্যাহত রাখার প্রয়োজন রয়েছে। সংস্কার শব্দটি রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে ভালোভাবে ঢুকতে পারে নি উল্লেখ করে জনাব এনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, দলের ভেতরে কর্তত্ববাদী কালচারের যথেষ্ট ও সমূহ সম্ভাবনা আরো অধিকরভাবে দেখা দিচ্ছে। তিনি বলেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক। জনাব রহমত আলী সংবিধানের বিভিন্ন ধারার কথা তুলে ধরে বলেন, যে সংস্কার আমার হাতে আছে সেই সংস্কারের ভিত্তিতে আমি কাজ করি না। এটা অহরহ লঙিঘত হচ্ছে। জনাব আসিফ নজরুল নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবে অনেকগুলো ভালো দিক আছে উল্লেখ করে বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, নির্বাচন কমিশনকে অসীম ক্ষমতাশালী একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে, কিন্তু এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়নি। যা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। যদি সম্পূর্ণভাবে দেশের মানুষের ওপর বিশ্বাস না থাকে তাহলে কী করে সংস্কার হবে? এই প্রশ্ন উত্থাপন করে জনাব মুহম্মদ জমির বলেন, গ্রামে-গঞ্জে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়া ও মতামত নেওয়া প্রয়োজন। ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এই নির্বাচন কমিশনের যে দায়িত্ব ছিল তাদের অনেক কার্যক্রম আমাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছে। রোডম্যাপের বিষয়ে তারা এখনো ৫-৬ মাস পিছিয়ে আছে। এছাড়া মনোনয়ন দেবার পূর্বেই প্রার্থীদের সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট তথ্যগুলো দলীয়ভাবে নেবার ব্যাপারেও আমরা চিন্তাভাবনা করছি বলে তিনি জানান। জনাব শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, আইনকানুনের সাথে সাথে আইন মানার জন্য রাজনৈতিক দলের ও নেতৃবৃন্দের মানসিকতার পরিবর্তনের প্রয়োজন।
এছাড়া গোলটেবিল আলোচনায় আরো বক্তব্য উপস্থাপন করেন জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদ, ড. মেহের-ই-খোদা, অধ্যাপক আসাদুজ্জামান, জনাব হুমায়ুন কবির হিরু, জনাব হান্নানভ বেগম, জনাব ওয়ালিউর রহমান, জনাব ম. হামিদ, জনাব নুরুল ইসলাম, জনাব আব্দুল হক, ড. ফেরদৌসী বেগম, জনাব হারুন অর রশিদ, জনাব এমএন ইসলাম তপন প্রমুখ। উপস্থিত সকলেই ‘সুজন’ প্রস্তাবিত প্রস্তাবনাসমূহের প্রতি ঐক্যমত্য পোষণ করেন।
**   কিনট পেপার

Related Post

“আসন্ন নির্বাচনে কেমন প্রার্থী চাই” শীর্ষক ‘সুজন’-এর গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত“আসন্ন নির্বাচনে কেমন প্রার্থী চাই” শীর্ষক ‘সুজন’-এর গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত

গত ৪ মার্চ ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিকে’র উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাব-এর ভিআইপি লাউঞ্জে “আসন্ন নির্বাচনে কেমন প্রার্থী চাই” শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে ‘সুজন’ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদ-এর

সুজন-এর উদ্যোগে ‘সমপ্রচার নীতিমালা, আইন ও সমপ্রচার কমিশন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনসুজন-এর উদ্যোগে ‘সমপ্রচার নীতিমালা, আইন ও সমপ্রচার কমিশন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালা-২০১৪ বাতিল করে গণমাধ্যমের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের মতামতের ভিত্তিতে সমপ্রচার আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন সুজন নেতৃবৃন্দ। গত ২১ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০.৩০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সুজন-সুশাসনের জন্য

‘নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন‘নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ইস্যুটি একটি সার্বজনীন বিষয় এবং এটি সকল নাগরিকের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাষ্ট্রপতিকে তাঁর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সংলাপ করার